Pages

মিলাদুন্নবী পালন করা,

যারা কতিপয় আহলে হক্বের নাম ভেঙ্গে মিলাদুন্নবী পালনের বৈধতা সাব্যস্ত করতে চায়, তাদেরকে এ প্রশ্নগুলো করুন।

যারা মিলাদুন্নবী পালন করা জায়েজ বলে এবং কতিপয় হক্কানী পীর মাশায়েখের উদ্ধৃতি উল্লেখপূর্বক তার বৈধতার পক্ষে দলিল প্রদান করার চেষ্টা চালায়, আপনি তাদেরকে নিচের প্রশ্নগুলো করুন!

আমাদের কতিপয় মীলাদী এবং মীলাদী কিয়াম ওয়ালারা নিজেদের মীলাদী আমলের সাফাই গাইতে গিয়ে পূর্ববর্তী কতেক মান্যগণ্য পীর ফকীরদের নাম ভেঙ্গে প্রচার করে বলে যে, ভাই! উনাদের সম্পর্কে আপনাদের ফতুয়া কী হতে পারে একটু বলবেন কি? তার মানে এই যে, উনারাও তো মিলাদুন্নবীর আমল করেছিলেন!

অতএব মিলাদুন্নবীর আমাল যদি “বিদয়াত” হয় কিংবা মিলাদুন্নবী আমলকারীরা যদি বিদয়াতি হন; তাহলে তো উনারাও বিদয়াতি হবেন, তাই নয় কি?

হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী, শাহ আব্দুর রাহিম দেহলবী ও আল্লামা জালালুদ্দিন আসসুয়ূতী রাহিমাহুমুল্লাহ উক্ত আসলাফদের অন্যতম, যাদের নাম ভেঙ্গে আধুনিক যুগের মীলাদীরা নিজেদের প্রচলিত মিলাদুন্নবী উদযাপন আর মীলাদী কিয়ামের সাফাই গাইতে শুরু করেন এবং উনাদের নাম ব্যবহার করে প্রচলিত ভিত্তিহীন মীলাদী আমলের শেষরক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

আগেই জানিয়ে দিচ্ছি যে, নির্দিষ্টভাবে কোনো সময় বা দিবসকে উপলক্ষ করা ব্যতীত, সহীহ আকিদা আর সত্যের মাপকাঠি সাহাবায়ে কেরামের নমুনায় উজ্জীবিত হয়ে নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মালোচনা মুসতাহসান ও অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ এ ব্যাপারে আহলে হক্ব উলামায়ে মক্কী ওয়া মাদানি ওয়া দেওবন্দী সকলেই একমত। দেওবন্দের প্রখ্যাত ফকিহ ও মুজাদ্দিদ আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (নাওয়ারাল্লাহ মারক্বাদাহু) উনি কত বড় সুন্নতে রাসূলের মূর্তপ্রতীক ছিলেন, তাঁরই রচনা “মুনাজাতে মাক্ববুল” আর “নশরুত্ত্বীব” ইত্যাদি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

এখানে আমি সংক্ষেপে আহলে হক্বের নাম ঙেগে আধুনিক মিলাদীদের সেই সব জালিয়াতি মূলত উদ্ধৃতির অসারতা প্রমাণ স্বরূপ (তাদেরই উদ্দেশ্যে) বেশ কিছু প্রশ্ন করব, আশাকরি জবাব দেবেন।

১-
মিলাদুন্নবী মানে কী?

২-
মিলাদুন্নবী মানে যদি “নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বা জন্মদিন” তাহলে সেটি উদযাপন কিংবা পালনকরার বিষয়, নাকি আলোচনার বিষয়?

৩-
যেসব আকাবীর ও হক্কানী পীর মাশায়েখের নাম ভেঙে মিলাদ কিয়ামের বৈধতার চ্যালেঞ্জ করা হয়ে থাকে, তারা কি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বা জন্মদিন” উদযাপন কিংবা পালন করতেন, নাকি আলোচনা করতেন?

৪-
মিলাদুন্নবী তথা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বা জন্মদিন উদযাপকরাকে আরবীতে কী বলে?

৫-
মিলাদুন্নবী তথা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মালোচনাকে আরবীতে কী বলে?

৬-
আহলে হক্ব মাশায়েখগণ নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মালোচনাকে বাদ দিয়ে, বরং জন্ম দিবস পালন করেছিলেন কিংবা জন্মদিবস উদযাপন করেছিলেন কি?

৭-
উনারা রেজভী তথা ভান্ডারী সুন্নীদের ন্যায় নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মুহাব্বত জাহিরের নামে জুলূসী ধুমদাড়াক্কার আয়োজন করেছিলেন কি? র্যলী আর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে “জিন্দা নবীর আগমণ, শুভেচ্ছা স্বাগতম” এ সমস্ত মনগড়া হাঁকড়াক ছেড়ে ছিলেন কি?

৮-

আসলাফের আহলে হক্বের কিতাবে এমন কোনো প্রমাণ আছে কি, যেখানে ১২ ই রবিউল আওয়াল দিবসকে উপলক্ষ করে নির্দিষ্ট দিনটিতে নবীজির জন্মদিন /জন্মদিবস পালন করেছিলেন ; যদি প্রমাণ থাকে তাহলে সহপ্রমাণে উল্লেখ করুন।

৯-
উনাদের কিতাবের ইবারত উল্লেখ করে আরো সুস্পষ্ট করে দিন যে, উনাদের মিলাদুন্নবী তথা নবীজীর জন্মালোচনা কি রকম পদ্ধতিতে ছিল, আর সাম্প্রতিক কালের মিলাদীদের মীলাদী আমলের সাথে উনাদের মিলাদুন্নবী তথা নবীজীর জন্মালোচনা বাহ্যিক ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে কি?

আমাদের তাহকীক অনুসারে সাম্প্রতিক কালের মিলাদীদের মীলাদী আমলের সাথে উনাদের মিলাদুন্নবী তথা নবীজীর জন্মালোচনা বাহ্যিক ভাবে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

১০-
আহলে হক্বের আকাবেরদের নামে মীলাদীরা যা প্রচার করে, তা বর্তমানকালের মিলাদ কিয়ামীদের মিলাদ কিয়ামের সাথে শব্দগত, মর্মগত ও আকিদাগত উভয় দিক থেকে আকাশ পাতাল ব্যবধান রয়েছে। এমতাবস্থায় আহলে হক্বের আকাবেরগ্ণ সাম্প্রতিককালের মিলাদীদের মীলাদী দৃষ্টান্ত হইল কেমনে?

১১-
আর যদি উনারা মিলাদুন্নবী উদযাপন কিংবা পালন নাহি করে থাকেন, তাহলে কি উনারা মিলাদুন্নবী তথা নবীজীর জন্মালোচনা করেছিলেন? আর আর যদি উনারা নবীজীর জন্মালোচনাই করে থাকেন, তাহলে এতে কারো কোনো সমস্যা বা দ্বিমত থাকতে পারে কি? আহলে হক্ব উলামায়ে মক্কী ওয়া মাদানি ওয়া দেওবন্দী তারা তো জন্মালোচনার বিষয়ে উম্মাহকে প্রতিনিয়ত আরো বেশি উৎসাহিত করে থাকেন, তা নয় কি?

১২-
হক্কানী পীর মাশায়েখের নিকট হতে যদি জন্মালোচনা ব্যতীত জন্মদিন উদযাপনের কোনো প্রমাণ নাহি থাকে, তাহলে আধুনিক কালের মিলাদীদের মিলাদুন্নবী উদযাপন বা জুলূসী ধুমদাড়াক্কার বৈধতা নিশ্চিত করার অসৎ উদ্দেশ্য পাকাপোক্ত করতে পূর্ববর্তী মাশায়েখের রেফারেন্স টেনে আনার মতলব কী তা কি একটু ব্যাখ্যা দেবেন?

১৩-
পূর্ববর্তী মাশায়েখদের দু একজনের যারাই কিয়াম করেছেন বলে জানা যায়, তাদের কারো কি এ আকিদা ছিল যে, নবীজি (সা) তিনি দরূদ পাঠকালে কিংবা নবীর জন্মালোচনার সময় মজলিসে হাজির বা আগমণ করেন! (নাউযুবিল্লাহ) ।

মজার ব্যাপার হল, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) – উনি নিজে না ছিলেন ফকিহ, না ছিলেন একজন মুজতাহিদ। কাজেই উনার কথা কিংবা কাজ শরীয়তের দৃষ্টিতে দলিল হিসেবে সাব্যস্ত হয় কিভাবে?

এ সম্পর্কে মুজতাহিদ ইমামগণের বক্তব্য :

মুজাদ্দিদে আলফে সানী শায়খ আহমদ সারহেন্দী রহঃ লিখেছেন-
ﻋﻤﻞ ﺻﻮﻓﻴۃ ﺩﺭ ﺣﻞ ﻭ ﺣﺮﻣﺖ ﺳﻨﺪ ﻧﻴﺴﺖ. ﺍﻟﻲ ﻗﻮﻟﻪ ﺍﯾﮟ ﺟﺎ ﻗﻮﻝ ﺍﻣﺎﻡ ﺍﺑﻮ ﺣﻨﯿﻔۃ ﺭﺡ ﻭ ﺍﻣﺎﻡ ﺍﺑﻮ ﯾﻮﺳﻒ ﺭﺡ ﻭ ﺍﻣﺎﻡ ﻣﺤﻤﺪ ﺭﺡ ﻣﻌﺘﺒﺮ ﺳﺖ. ﻧﮧ ﻋﻤﻞ ﺍﺑﻮﺑﮑﺮ ﺷﺒﻠﯽ ﻧﻮﺭﯼ ﺭﺡ .

অনুবাদ, কোনো কাজ হালাল বা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোনো সূফী বুযূর্গের (পীর ফকিরের ব্যক্তিগত) আমল দলীল নয়।বরং এ ক্ষেত্রে হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ, ইমাম আবু ইউসূফ রহঃ ও ইমাম মুহাম্মদ রহঃ প্রমুখ মুজতাহিদ ইমামগণের কথা দলীল।

প্রখ্যাত সূফী বুযূর্গ আবু বকর শিবলী নূরী রহঃ এর কাজও শরীয়তে দলীল হতে পারেনা। {দেখুন, মাকতুবাত, দপ্তরে আউয়াল পৃষ্ঠা ২৩৫}

জনৈক কবি কতইনা সুন্দর করে বলেছেন- ﮨﮯ ﺗﺒﺎﮨﯽ ﺩﯾﻦ ﮐﯽ ﺍﻥ ﺗﯿﻦ ﺳﮯ. ﭘﯿﺮ ﺟﺎﮨﻞ ﻣﯿﺮ ﻇﺎﻟﻢ ﻋﺎﻟﻢ ﺑﺪ ﺩﯾﻦ ﺳﮯ .

অনুবাদ, তিন শ্রেণির মানুষ ধর্মের সর্বনাশ ডেকে আনে। জালিম বাদশাহ, জাহেল পীর ফকির আর বদদ্বীন মৌলভী।”

ইমাম বুখারীর উস্তাত হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারক তিনিও বলেছেন-
ﻭ ﻫﻞ ﺍﻓﺴﺪ ﺍﻟﺪﻳﻦ ﺍﻻ ﺍﻟﻤﻠﻮﻙ. ﻭ ﺍﺣﺒﺎﺭ ﺳﻮﺀ ﻭ ﺭﻫﺒﺎﻧﻬﺎ
.
অনুবাদ, তিন শ্রেণির মানুষ দ্বীনের ক্ষতি করে। বাদশাগণ, বদদ্বীন মৌলভী আর (মূর্খ) পীর ফকিরেরা।”

হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইবনে দাকীকুল ঈদ্ রহঃ লিখেছেন-
ﺍﻥ ﺍﻟﻐﺎﻟﺐ ﻓﻲ ﺍﻟﻌﺒﺎﺩﺍﺕ ﺍﻟﺘﻌﺒﺪ ﻭ ﻣﺄﺧﺬﻫﺎ ﺍﻟﺘﻮﻗﻴﻒ . ﻫﻜﺬﺍ ﻗﺎﻝ ﺩﻗﻴﻖ ﺍﻟﻌﻴﺪ

অনুবাদ, ইবাদত সমূহে উদ্দেশ্য হল আল্লাহপাকের বন্দেগী করা। আর এর ভিত্তি হল ওহী নির্ভরতা।” {দেখুন এহকামুল আহকাম ১/৫১}

কাজেই বুঝা গেল, কোন্ কাজ করলে আল্লাহপাক খুশি হবেন, সাওয়াব দিবেন, এটা কোনো পীর ফকিরের যুক্তি বুদ্ধি বা আবেগে সাব্যস্ত হবার বিষয় নয়, এ জন্য ওহী তথা শরীয়তের সুস্পষ্ট ফয়সালা জুরুরী।

আরো মজার কথা হল, নবীজির জন্মালোচনা মুহূর্তে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) – কৃত কথিত কিয়ামের মাকসাদ বা উদ্দেশ্য-মজলিসে নবীজী (সা) হাজির হতেন এরকম কোনো আকিদাই ছিল না; বরং তিনি বলতেন : اور قیام کے وقت بے حد لطف و لذت پاتا ہون (এবং কিয়াম করার সময় অশেষ আনন্দ এবং মজা উপলব্ধি করি)। [হাফত মাসায়েল-৫]

তাছাড়া নবীজির জন্মালোচনা মুহূর্তে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) – কৃত কথিত কিয়াম মাজযূবী হালতে (নবীজির মুহাব্বতে জ্ঞানশূন্য অবস্থায়) ছিল। প্রকৃত ওলীদের মাজযূবী হালতে সংঘটিত অস্বাভাবিক কোনো কাজ অন্যদের জন্য অনুকরণযোগ্য হতে পারেনা।

আর যদি প্রকৃত ওলীদের মাজযূবী হালতে সংঘটিত অস্বাভাবিক কোনো কাজ অন্যদের জন্য অনুকরণযোগ্য হত, তাহলে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ)-এর চেয়েও অপেক্ষাকৃত বড় আশেকে রাসূল হযরত ওয়াইসকরণী (রহঃ) এর ন্যায় বর্তমানকালের তথাকথিত কোনো আশেকে রাসূল নিজের দাঁত উপড়ে ফেলা শরয়ী ফয়সালা মতে জায়েজ হবে কি?
অনুরূপ বিশিষ্ট মাজযূব হযরত মানসূর হাল্লাজ (রহঃ)-এর ন্যায় “আনাল হক্ব” (আমিই আল্লাহ) বলা সহীহ হবে কি?

১৪-
যদি মিলাদুন্নবীর আমলকালে নবীজি (সা) মজলিসে হাজিরই হন, যে জন্য (রেজভী বিদয়াতিদের ভাষ্য মতে তাজিমের উদ্দেশ্যে) কিয়াম করা লাগে; তাহলে এ মিলাদুন্নবীর প্রথা ৬০৪ হিজরীতে সর্বপ্রথম যিনি আবিস্কার করে চালু করেছিলেন তিনি কী জন্য কিয়াম করেননি? তারও প্রায় ১০০ বছর পর হতেই তথা ৭০০ হিজরীতে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে এ অভিনব কিয়ামের নতুন সংযোজন হল কেন?

১৫-
কতিপয় ভান্ডারী সুন্নী ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (নবীজির জন্ম/ জন্মদিবস) উদযাপন প্রথাটিকে “বিদয়াতে হাসানাহ” বলে প্রচার করছে, আবার কেউ বা “সুন্নাতে সাহাবা” বলেও আখ্যায়িত করছে। এখন আমার প্রশ্ন, যেটি “সুন্নাতে সাহাবা” সেটি বিদয়াতে হাসানাহ হয় কিভাবে? কারণ, শরীয়তের ভেতর যা “সুন্নাতে সাহাবা” হিসেবে আখ্যায়িত, তা কোনো ভাবেই বিদয়াতে হাসানার পর্যায়ভুক্ত হতে পারেনা। তাহলে এমতাবস্থায় প্রচলিত মিলাদুন্নবী পালনের প্রকৃত শরয়ী বিধানটি কী, একটু বলবেন?

আশাকরি তাদের বিভ্রান্তি কোথায় তা বুঝতে পেরেছেন।

No comments:

Post a Comment