বর্তমানে ইসলামের জন্য যা করা দরকার,

ওয়াজ নয়, বর্তমানে ইসলামের জন্য যা করা দরকার
-----------------------------------------------------------------------------
 মাওলানা মুহিউদ্দীন কাসেমী (দা.বা.)

[বিষয়গুলো একান্তই আমার ভাবনা। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে চিন্তা করে। তাই সহমত ও দ্বিমত স্বাভাবিক। কিন্তু অযাচিত-অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য অনভিপ্রেত।]
.
একজনের খাবার নেই; খাবারের অভাবে জীবন সঙ্কটাপন্ন।  তবে কাপড়চোপড় আছে মোটামুটি। এখন সামাজিক নিয়ম রক্ষার্থে আপনি তার বাড়িতে দামি কাপড় নিয়ে গেলেন। তার তো কাপড়ের চেয়ে হাজার গুণ বেশি খাবারের!
.
শীতকাল আসছে। চারদিকে মধ্যরাত অবধি ওয়াজ মাহফিল হবে। শ্রোতার সংখ্যাও কম নয়। বিষয়টি ইতিবাচক হলেও আমার দৃষ্টিতে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে তেমন উপকারী নয়। সবাই যে টাকাপয়সা বা সুনাম-সুখ্যাতির জন্য ওয়াজ করছে বা করাচ্ছে, ব্যাপারটি তা নয়। কারও কারও ইখলাস না থাকার মানে এই নয় যে, সবারই ইখলাস নেই। তবুও এতবেশি ওয়াজ মাহফিল করার দ্বারা ফায়দা হচ্ছে না।
প্রশ্ন হয় তাহলে ইসলামের সেবায় কী কাজ করা প্রয়োজন?
বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় কয়েকটি কাজ করা আবশ্যক মনে হচ্ছে :
০১. প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মসজিদে নিয়মিত ইমাম নেই। থাকলেও ইমামের তেলাওয়াত শুদ্ধ নয়। ইমামের বেতনও অনেক কম। তাও কয়েক মাস বাকি! প্রতিটি মসজিদে বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের অধিকারী ইমাম নিযুক্ত করে মোটামুটি যথেষ্ট বেতনের ব্যবস্থা করা দরকার। অথচ দেখা যায়, ইমামের বেতনের খবর নাই কিন্তু পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বক্তা এনে ওয়াজ করায়!
০২. প্রতিটি মসজিদে মক্তব নেই। থাকলেও বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের অধিকারী নুরানি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। মক্তবে কুরআন তেলাওয়াত শিখানোর পাশাপাশি ফরজ আইন পরিমাণ দীনি জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা আবশ্যক। পঞ্চম শ্রেণীতে ৩০ লাখ ছেলেমেয়ে অংশগ্রহণ করেছে; তাদের কয়জনে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে? তাদের কুরআন তেলাওয়াত ও দীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা আমাদের দায়িত্ব নয়?
০৩. গ্রামেগঞ্জে ও মহল্লায় মহল্লায় সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ইসলামে সুদের ভয়াবহতা সবারই জানা। সুদ হতে এ সমাজকে মুক্ত করার প্রধান উপকরণ হল করজে হাসানা। যে জাতি কোটি কোটি টাকা দান করতে পারে তাদেরকে বুঝালে কোটি কোটি টাকা করজে হাসানা দিতেও প্রস্তুত হবে। আমরা বুঝাতে পারি না, তাই দেয় না। ঋণ দিলে দানের সওয়াব পাওয়া যায়। একটি মাহফিলে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়। অনেক মানুষ বারবার হজ ওমরা করে। তাদেরকে দীনের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বুঝালে বুঝবে না? বারবার হজ-ওমরা করা একটি পিকনিকে পরিণত হয়েছে (নাউজুবিল্লাহ; ব্যতিক্রমদের কথা ভিন্ন)।
০৪. যার যার সমাজে ও মহল্লায় মুসুল্লিদের নিয়ে নিয়মিত পরামর্শ করা। দলমত নির্বিশেষে। এলাকায় ইসলামবিরোধী কোনো কাজ হলে বাধা দেওয়া। মহল্লাভিত্তিক সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করা।
০৫. ইসলামী সব দল, মত ও পথের লোকজনকে একত্রিত হয়ে ইসলামবিরোধী আইন-কানুন ও শিক্ষানীতির বিরোধিতা করা, প্রতিবাদ করা। কে কোন্ দলের, কোন্ মতের এটা দেখা হবে না। হেফাজত, জামায়াত, আহলে হাদিস, এমনকি আমরা যাদেরকে বিদাতি বলি তাদের সবাইকে নিয়ে বসা দরকার। কমন বিষয়গুলোতে কারও মতানৈক্য থাকার কথা নয়।
ভারতে দেওবন্দি, জামায়াতি, রেজভিসত সকল পথের আলেমদের নিয়ে মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড গঠিত হয়। মাও. কারী তৈয়্যব রহ. ও মাওলানা আবুল হাসান আলী মিয়া রহ. এর নেতৃত্বে।
পাকিস্তানের জামায়াতের আমীর মরহুম হুসাইন সাহেবের জানাযায় প্রথম কাতারে ছিলেন মাও. ফজলুর রহমান।
ভারতের আজমীরে জমিয়তের নেতৃত্বে সব পথ ও মতের আলেমদের নিয়ে বিশ্ব শান্তি সম্মেলন হচ্ছে।
ভারত ও পাকিস্তানের নজির বাংলাদেশে স্থাপন করা যায় না? বিষয়টি না বুঝার কারণে ক্ষতি যা হওয়ার ইতোমধ্যে হয়ে গেছে; তবুও যত দ্রুত বুঝব ক্ষতি ততই হ্রাস পাবে।
০৬. বাংলাদেশে কোনো সময় নিরপেক্ষ ভোটের আয়োজন হলে (যদিও অসম্ভব), সকল ইসলামী দল কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট করে নির্বাচন করতে পারে। সামান্য মতপার্থক্য সঙ্গে নিয়েই কিছু বিষয়ে একমত হয়ে কাজ করতে হবে। পারস্পরিক মতপার্থক্যগুলো থাকুক। কেয়ামত পর্যন্তই সেগুলো থাকবে।
০৭. মানহাজী ও ইজতেহাদী মতপার্থক্যগুলোর কারণে সমাজে একধরনের অনৈক্য কাজ করছে; যা ইতোপূর্বে কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। যুগযুগ ধরে হানাফী ফিকহ অনুযায়ী এদেশের মানুষ শরিয়াহর ওপর আমল করে আসছে। এর বিপরীত আরেকটি নতুন ধারা প্রবর্তনের কী দরকার? এ ধরনের বিরোধে কার ক্ষতি হয়েছে? নিরপক্ষে দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করা উচিত। এগুলো পরিহার করা উচিত। তবে তাহকীকের জন্যে হলে কোনো সমস্যা নেই।
০৮. প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে নিজে কুরআন-সুন্নাহর ওপর আমল করার চেষ্টা করা দরকার। সাহাবীদের আদর্শের অনুসারী হওয়া চাই। যখন যার ওপর আল্লাহর যে বিধান আবশ্যক হয় তা মেনে চলা আবশ্যক। নিজে ঠিক না হলে অন্যরা ঠিক হবে না। তৎসঙ্গে নিজের পরিবার ও নিকটজনদের দীনের ওপর চলার দাওয়াত দেওয়া। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে : يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَاراً “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।”
সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা শুধু আলেম-ওলামা ও মুরুব্বিদের সমালোচনা করে বেড়ায়। অমুক দল কেন এটা করল না? অমুক মাওলানা একটা ডাক দিলেই তো বাংলাদেশে ইসলাম কায়েম হয়ে যেত! অমুক হুজুর কেন এ কাজ করল? তারা কেন এই কিতাব পড়ে? তারা কেন এই কাজ করে? ইত্যাদি। অথচ তাদের মুখে দাড়ি নেই, মাঝেমধ্যে নামায পড়ে, পরিবারে পর্দা নেই, কুরআন পড়তে জানে না। এরা অর্বাচীন কিংবা জ্ঞানপাপী।
ব্যক্তি থেকে পরিবার হয়ে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র-- এভাবে সর্বত্র ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে।
-------------------------
পুনশ্চ : মসজিদভিত্তিতক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। মহল্লাবাসীর দীনি প্রায় সব প্রয়োজন মসজিদ হতেই পূরণ করা হোক। ঈমান-আমল-আখলাকের বাস্তবিক শিক্ষা হোক মসজিদে মসজিদে। সপ্তাহে কিংবা দুই সপ্তাহে একদিন মসজিদে আমলী মশক করা দরকার। অসংখ্য হাদিসে আছে, সাহাবায়ে কেরাম অজুর পদ্ধতি মুখে না বলে অজুর পানি আনিয়ে সবার সামনে অজু করে বলেছেন, এভাবে রাসুল সা. অজু করেছেন। তদ্রƒপ নামায রোযা হজ যাকাত সব বিষয় মসজিদে শিক্ষা দেওয়া হোক। সাহাবায়ে কেরামের যুগে প্রত্যেকটি মসজিদ এমনই ছিল। স্থানীয় ইমাম/খতিব/আলেমগণ আলোচনা করবেন, শিক্ষা দিবেন। প্রয়োজনে আশপাশের আলেম-ওলামাদের ডাকা যেতে পারে। এটাই ওয়াজ। লাখ লাখ টাকা খরচ করে চুক্তিবাদীদের দ্বারা ওয়াজ করানো বন্ধ হোক।

(Mohiuddin Kasemi)

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

একটু চিন্তা করুন ।

                      أعوذ بالله من الشيطان الرجيم                           بسم الله الرحمن الرحيم                 সকল মুসলিম ভাই বোন ক...

Search This Blog

Followers