নামায,পুরুষের জন্য নামাজে হাত বাঁধার নিয়ম বিস্তারিত দলীল সহ!



হাত বাঁধার নিয়ম দুইটি ১। নাভির নিচে ২। নাভির উপর। তৃতীয় কোন নিয়ম নেই।

হাত কোথায় বাঁধা হবে তো এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে হাত বাঁধতেন এবং সাহাবায়ে কেরামও হাত বাঁধতেন। এখন প্রশ্ন হল, কোথায় তাঁরা হাত বাঁধতেন? মৌখিক বর্ণনায় হাত বাঁধার মূল প্রসঙ্গ যত পরিষ্কারভাবে এসেছে কোথায় বাঁধতেন তা সেভাবে আসেনি। কেন আসেনি? আসার প্রয়োজন হয়নি। কারণ সবাই হাত বাঁধছেন। কোথায় বাঁধছেন তা সবার সামনেই পরিষ্কার। কাজেই তা মুখে বর্ণনা করার প্রয়োজন হয়নি। তো যে সুন্নাহ কর্মে ও অনুসরণে ব্যাপকভাবে রয়েছে তা মৌখিক বর্ণনায় সেভাবে নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে পরের যুগের লোকদের জন্য সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল ও ফতোয়া সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁরা ঐ সময়ের কর্ম ও অনুশীলনের প্রত্যক্ষদর্শী।
নামাযে হাত বাঁধার সুন্নাহর উপর সাহাবা-তাবেয়ীন কীভাবে আমল করেছেন-এ বিষয়ে ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯ হি.) বলেন-
والعمل على هذا عند أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم والتابعين ومن بعدهم، يرون أن يضع الرجل يمينه على شماله في الصلاة، ورأى بعضهم أن يضعهما فوق السرة، ورأى بعضهم أن يضعهما تحت السرة، وكل ذلك واسع عندهم.
অর্থাৎ আহলে ইলম সাহাবা-তাবেয়ীন ও তাঁদের পরবর্তী মনীষীগণ এই হাদীসের উপর (ডান হাত দ্বারা বাম হাত ধরা) আমল করেছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত এই ছিল যে, নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতে হবে। তাঁদের কেউ নাভীর উপর হাত রাখার কথা বলতেন, আর কেউ নাভীর নিচে রাখাকে (অগ্রগণ্য) মনে করতেন। (তবে) দুটো নিয়মই তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল।-জামে তিরমিযী ১/৩৪
বস্ত্তত এটা হচ্ছে হাত বাঁধার হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক পদ্ধতি। সাহাবা-তাবেয়ীনের যমানা থেকে এ দুটি নিয়মই চলে আসছে। পরবর্তীতে জুমহূর ফকীহ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এ দুই নিয়ম গ্রহণ করেছেন। এভাবে উম্মাহর তাওয়ারুছ ও ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে নামাযে হাত বাঁধার যে নিয়ম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছেছে তা উল্লেখিত হাদীসসমূহেরই ব্যবহারিক রূপ। এ কারণে পরবর্তী যুগে বিচ্ছিন্ন কোনো নিয়ম আবিষ্কার করে তাকে হাদীস শরীফের উপর আরোপ করা হাদীসের তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

উপরোক্ত দুই নিয়মের মাঝে নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মটি রেওয়ায়েতের বিচারে অগ্রগণ্য। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. (২৩৮ হি.) বলেছেন, ‘নাভীর নিচে হাত বাঁধা রেওয়ায়েতের বিচারে অধিক শক্তিশালী এবং ভক্তি ও বিনয়ের অধিক নিকটবর্তী।’
تحت السرة أقوى في الحديث تحت السرة أقوى في الحديث وأقرب إلى التواضع
 তাবেয়ী আবু মিজলায লাহিক ইবনে হুমাইদ রাহ. (মৃত্যু : ১০০ হি.-এর পর) নামাযে কোথায় হাত বাঁধবে-এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬৩
এই রেওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই -
حدثنا يزيد بن هارون قال : أخبرنا الحجاج بن حسان قال : سمعت أبا مجلز ـ أو سألته ـ قال : قلت كيف أصنع؟ قال : يضع باطن كف يمنيه على ظاهر كف شماله ويجعلها أسفل من السرة.
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.ও (মৃত্যু : ৯৬ হি.) এই ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬০
এই রেওয়ায়েতের সনদ হাসান। সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই-
حدثنا وكيع، عن ربيع، عن أبي معشر، عن إبراهيم قال : يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রাহ. (১৮৯ হি.) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. নাভীর নিচে হাত বাঁধতেন। এরপর তিনি বলেন, ‘আমরা এই নিয়মই অনুসরণ করি এবং এটিই (ইমাম) আবু হানীফার সিদ্ধান্ত।’-কিতাবুল আছার, হাদীস : ১২১
সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই-
قال محمد : أخبرنا الربيع بن صبيح، عن أبي معشر، عن إبراهيم : أنه كان يضع يده اليمنى على يده اليسرى تحت السرة. قال محمد : وبه نأخذ وهو قول أبي حنيفة رحمه الله. (كتاب الصلاة، باب الصلاة قاعدا والتعمد على شيء أو يصلي إلى سترة)
প্রসঙ্গত আগেই বলা হয়েছে যে, সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল হচ্ছে হাত বাঁধা সংক্রান্ত মারফূ হাদীসসমূহের ব্যবহারিক রূপ। এ কারণে মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ-এর সূত্রে হাত বাঁধার মরফূ হাদীস বর্ণনা করার পর এই নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন।
রেওয়ায়েতটি এই-
أخبرنا أبو حنيفة، عن حماد عن إبراهيم أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يعتمد بإحدى يديه على الأخرى في الصلاة، يتواضع لله تعالى. قال محمد : ويضع بطن كفه الأيمن على رسغه الأيسر، تحت السرة، فيكون الرسغ في وسط الكف، (كتاب الأثار، كتاب الصلاة، باب الصلاة قاعدا والتعمد على شيء أو يصلي إلى سترة)
ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এক হাতের উপর অন্য হাত বাঁধতেন। এভাবে তিনি আল্লাহর সামনে বিনীত হতেন।’
(ইমাম) মুহাম্মাদ বলেন, ‘ডান হাতের তালু বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে, নাভীর নিচে; সুতরাং কব্জি থাকবে হাতের তালুর মাঝে।’-কিতাবুল আছার, হাদীস : ১২০
খাইরুল কুরূন ও পরবর্তী যুগের হাদীস ও ফিকহের বিখ্যাত ইমামগণও নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ইবনে কুদামা হাম্বলী রাহ. (৬২০ হি.) বলেন, নামাযে কোথায় হাত বাঁধা হবে এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা আছে। (ইমাম) আহমদ রাহ. থেকে বর্ণিত, দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। এটি (হযরত) আলী রা., আবু হুরায়রা রা., আবু মিজলায রাহ., ইবরাহীম নাখায়ী রাহ., (সুফিয়ান) ছাওরী রাহ., ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) রাহ. থেকে বর্ণিত।-আলমুগনী ২/১৪১

উল্লেখ্য, ইবনে কুদামা হাম্বলী রাহ. ‘আলমুগনী’তে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. থেকে মোট তিনটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। তবে মূল মতন অর্থাৎ ‘মুখতাসারুল খিরাকী’তে শুধু নাভীর নিচে হাত বাঁধার কথাই বলা হয়েছে।
আরবী পাঠ-ويجعلهما ويجعلهما تحت سرته
‘মুখতাসারে’র ভূমিকায় লেখক ইমাম আবুল কাসিম উমার ইবনুল হুসাইন আলখিরাকী (৩৩৪ হি.) বলেছেন, ‘আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মাযহাব অনুসারে (শরীয়তের মাসাইল) এই কিতাবে সংকলন করেছি।’
اختصرت هذا الكتاب ليقرب على متعلمه على مذهب أبي عبد الله أحمد بن محمد بن حنبل رضي الله عنه.
-আলমুগনী ১/৭-৮
শায়খ আবুল হুসাইন ইয়াহইয়া ইবনে আবুল খায়ের রাহ. (মৃত্যু  ৫৫৮ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু ইসহাক (আলমারওয়াযী) রাহ. বলেছেন, ‘এক হাত অন্য হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-আলবায়ান ফী মাযাহিবিল ইমামিশ শাফেয়ী ২/১৭৫
উল্লেখ্য, ইমাম আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ. শাফেয়ী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ মনীষী। ইমাম শাফেয়ী রাহ. নাভীর উপর (বুকের নিচে) হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করলেও আবু ইসহাক মারওয়াযী নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মকেই অগ্রগণ্য মনে করেছেন।
ইমাম নববী রাহ. (৬৭৬ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু হানীফা, (সুফিয়ান) ছাওরী ও ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) বলেন, ‘দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। আমাদের (শাফেয়ী )  মধ্যে আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ.ও তা গ্রহণ করেছেন। আর ইবনুল মুনযির তা বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রা, (ইবরাহীম) নাখায়ী ও আবু মিজলায রাহ. থেকে।
তিনি আরো বলেন, ‘আলী ইবনে আবী তালিব রা. থেকে দুটি রেওয়ায়েত আছে : এক. নাভীর উপর হাত বাঁধা, দুই. নাভীর নিচে হাত বাঁধা।
-আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব ৪/৩৩০

#নাভীর নীচে হাত বাঁধার সহীহ হাদীস

হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণিত, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নীচে রেখেছেন। সনদসহ রেওয়ায়েতের আরবী পাঠ এই-

حدثنا وكيع، عن موسى بن عمير، عن علقمة بن وائل بن حجر، عن أبيه قال : رأيت النبي صلى الله عليه وسلم  يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.

-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৫১

এই বর্ণনার সনদ সহীহ। ইমাম কাসেম ইবনে কুতলূবুগা রাহ. (৮৭৯ হি.) বলেন- وهذا اسناد جيد

এটি একটি উত্তম সনদ।-আততা’রীফু ওয়াল ইখবার রিতাখরীজি আহাদীছিল ইখতিয়ার-হাশিয়া শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা।

বুকের উপর হাত বাঁধার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।।

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

একটু চিন্তা করুন ।

                      أعوذ بالله من الشيطان الرجيم                           بسم الله الرحمن الرحيم                 সকল মুসলিম ভাই বোন ক...

Search This Blog

Followers