নামায,পুরুষের জন্য নামাজে হাত বাঁধার নিয়ম বিস্তারিত দলীল সহ!



হাত বাঁধার নিয়ম দুইটি ১। নাভির নিচে ২। নাভির উপর। তৃতীয় কোন নিয়ম নেই।

হাত কোথায় বাঁধা হবে তো এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে হাত বাঁধতেন এবং সাহাবায়ে কেরামও হাত বাঁধতেন। এখন প্রশ্ন হল, কোথায় তাঁরা হাত বাঁধতেন? মৌখিক বর্ণনায় হাত বাঁধার মূল প্রসঙ্গ যত পরিষ্কারভাবে এসেছে কোথায় বাঁধতেন তা সেভাবে আসেনি। কেন আসেনি? আসার প্রয়োজন হয়নি। কারণ সবাই হাত বাঁধছেন। কোথায় বাঁধছেন তা সবার সামনেই পরিষ্কার। কাজেই তা মুখে বর্ণনা করার প্রয়োজন হয়নি। তো যে সুন্নাহ কর্মে ও অনুসরণে ব্যাপকভাবে রয়েছে তা মৌখিক বর্ণনায় সেভাবে নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে পরের যুগের লোকদের জন্য সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল ও ফতোয়া সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁরা ঐ সময়ের কর্ম ও অনুশীলনের প্রত্যক্ষদর্শী।
নামাযে হাত বাঁধার সুন্নাহর উপর সাহাবা-তাবেয়ীন কীভাবে আমল করেছেন-এ বিষয়ে ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯ হি.) বলেন-
والعمل على هذا عند أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم والتابعين ومن بعدهم، يرون أن يضع الرجل يمينه على شماله في الصلاة، ورأى بعضهم أن يضعهما فوق السرة، ورأى بعضهم أن يضعهما تحت السرة، وكل ذلك واسع عندهم.
অর্থাৎ আহলে ইলম সাহাবা-তাবেয়ীন ও তাঁদের পরবর্তী মনীষীগণ এই হাদীসের উপর (ডান হাত দ্বারা বাম হাত ধরা) আমল করেছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত এই ছিল যে, নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতে হবে। তাঁদের কেউ নাভীর উপর হাত রাখার কথা বলতেন, আর কেউ নাভীর নিচে রাখাকে (অগ্রগণ্য) মনে করতেন। (তবে) দুটো নিয়মই তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল।-জামে তিরমিযী ১/৩৪
বস্ত্তত এটা হচ্ছে হাত বাঁধার হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক পদ্ধতি। সাহাবা-তাবেয়ীনের যমানা থেকে এ দুটি নিয়মই চলে আসছে। পরবর্তীতে জুমহূর ফকীহ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এ দুই নিয়ম গ্রহণ করেছেন। এভাবে উম্মাহর তাওয়ারুছ ও ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে নামাযে হাত বাঁধার যে নিয়ম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছেছে তা উল্লেখিত হাদীসসমূহেরই ব্যবহারিক রূপ। এ কারণে পরবর্তী যুগে বিচ্ছিন্ন কোনো নিয়ম আবিষ্কার করে তাকে হাদীস শরীফের উপর আরোপ করা হাদীসের তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

উপরোক্ত দুই নিয়মের মাঝে নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মটি রেওয়ায়েতের বিচারে অগ্রগণ্য। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. (২৩৮ হি.) বলেছেন, ‘নাভীর নিচে হাত বাঁধা রেওয়ায়েতের বিচারে অধিক শক্তিশালী এবং ভক্তি ও বিনয়ের অধিক নিকটবর্তী।’
تحت السرة أقوى في الحديث تحت السرة أقوى في الحديث وأقرب إلى التواضع
 তাবেয়ী আবু মিজলায লাহিক ইবনে হুমাইদ রাহ. (মৃত্যু : ১০০ হি.-এর পর) নামাযে কোথায় হাত বাঁধবে-এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬৩
এই রেওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই -
حدثنا يزيد بن هارون قال : أخبرنا الحجاج بن حسان قال : سمعت أبا مجلز ـ أو سألته ـ قال : قلت كيف أصنع؟ قال : يضع باطن كف يمنيه على ظاهر كف شماله ويجعلها أسفل من السرة.
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.ও (মৃত্যু : ৯৬ হি.) এই ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬০
এই রেওয়ায়েতের সনদ হাসান। সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই-
حدثنا وكيع، عن ربيع، عن أبي معشر، عن إبراهيم قال : يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রাহ. (১৮৯ হি.) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. নাভীর নিচে হাত বাঁধতেন। এরপর তিনি বলেন, ‘আমরা এই নিয়মই অনুসরণ করি এবং এটিই (ইমাম) আবু হানীফার সিদ্ধান্ত।’-কিতাবুল আছার, হাদীস : ১২১
সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই-
قال محمد : أخبرنا الربيع بن صبيح، عن أبي معشر، عن إبراهيم : أنه كان يضع يده اليمنى على يده اليسرى تحت السرة. قال محمد : وبه نأخذ وهو قول أبي حنيفة رحمه الله. (كتاب الصلاة، باب الصلاة قاعدا والتعمد على شيء أو يصلي إلى سترة)
প্রসঙ্গত আগেই বলা হয়েছে যে, সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল হচ্ছে হাত বাঁধা সংক্রান্ত মারফূ হাদীসসমূহের ব্যবহারিক রূপ। এ কারণে মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ-এর সূত্রে হাত বাঁধার মরফূ হাদীস বর্ণনা করার পর এই নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন।
রেওয়ায়েতটি এই-
أخبرنا أبو حنيفة، عن حماد عن إبراهيم أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يعتمد بإحدى يديه على الأخرى في الصلاة، يتواضع لله تعالى. قال محمد : ويضع بطن كفه الأيمن على رسغه الأيسر، تحت السرة، فيكون الرسغ في وسط الكف، (كتاب الأثار، كتاب الصلاة، باب الصلاة قاعدا والتعمد على شيء أو يصلي إلى سترة)
ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এক হাতের উপর অন্য হাত বাঁধতেন। এভাবে তিনি আল্লাহর সামনে বিনীত হতেন।’
(ইমাম) মুহাম্মাদ বলেন, ‘ডান হাতের তালু বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে, নাভীর নিচে; সুতরাং কব্জি থাকবে হাতের তালুর মাঝে।’-কিতাবুল আছার, হাদীস : ১২০
খাইরুল কুরূন ও পরবর্তী যুগের হাদীস ও ফিকহের বিখ্যাত ইমামগণও নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ইবনে কুদামা হাম্বলী রাহ. (৬২০ হি.) বলেন, নামাযে কোথায় হাত বাঁধা হবে এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা আছে। (ইমাম) আহমদ রাহ. থেকে বর্ণিত, দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। এটি (হযরত) আলী রা., আবু হুরায়রা রা., আবু মিজলায রাহ., ইবরাহীম নাখায়ী রাহ., (সুফিয়ান) ছাওরী রাহ., ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) রাহ. থেকে বর্ণিত।-আলমুগনী ২/১৪১

উল্লেখ্য, ইবনে কুদামা হাম্বলী রাহ. ‘আলমুগনী’তে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. থেকে মোট তিনটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। তবে মূল মতন অর্থাৎ ‘মুখতাসারুল খিরাকী’তে শুধু নাভীর নিচে হাত বাঁধার কথাই বলা হয়েছে।
আরবী পাঠ-ويجعلهما ويجعلهما تحت سرته
‘মুখতাসারে’র ভূমিকায় লেখক ইমাম আবুল কাসিম উমার ইবনুল হুসাইন আলখিরাকী (৩৩৪ হি.) বলেছেন, ‘আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মাযহাব অনুসারে (শরীয়তের মাসাইল) এই কিতাবে সংকলন করেছি।’
اختصرت هذا الكتاب ليقرب على متعلمه على مذهب أبي عبد الله أحمد بن محمد بن حنبل رضي الله عنه.
-আলমুগনী ১/৭-৮
শায়খ আবুল হুসাইন ইয়াহইয়া ইবনে আবুল খায়ের রাহ. (মৃত্যু  ৫৫৮ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু ইসহাক (আলমারওয়াযী) রাহ. বলেছেন, ‘এক হাত অন্য হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে।’-আলবায়ান ফী মাযাহিবিল ইমামিশ শাফেয়ী ২/১৭৫
উল্লেখ্য, ইমাম আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ. শাফেয়ী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ মনীষী। ইমাম শাফেয়ী রাহ. নাভীর উপর (বুকের নিচে) হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করলেও আবু ইসহাক মারওয়াযী নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মকেই অগ্রগণ্য মনে করেছেন।
ইমাম নববী রাহ. (৬৭৬ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু হানীফা, (সুফিয়ান) ছাওরী ও ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) বলেন, ‘দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। আমাদের (শাফেয়ী )  মধ্যে আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ.ও তা গ্রহণ করেছেন। আর ইবনুল মুনযির তা বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রা, (ইবরাহীম) নাখায়ী ও আবু মিজলায রাহ. থেকে।
তিনি আরো বলেন, ‘আলী ইবনে আবী তালিব রা. থেকে দুটি রেওয়ায়েত আছে : এক. নাভীর উপর হাত বাঁধা, দুই. নাভীর নিচে হাত বাঁধা।
-আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব ৪/৩৩০

#নাভীর নীচে হাত বাঁধার সহীহ হাদীস

হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণিত, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নীচে রেখেছেন। সনদসহ রেওয়ায়েতের আরবী পাঠ এই-

حدثنا وكيع، عن موسى بن عمير، عن علقمة بن وائل بن حجر، عن أبيه قال : رأيت النبي صلى الله عليه وسلم  يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.

-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৫১

এই বর্ণনার সনদ সহীহ। ইমাম কাসেম ইবনে কুতলূবুগা রাহ. (৮৭৯ হি.) বলেন- وهذا اسناد جيد

এটি একটি উত্তম সনদ।-আততা’রীফু ওয়াল ইখবার রিতাখরীজি আহাদীছিল ইখতিয়ার-হাশিয়া শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা।

বুকের উপর হাত বাঁধার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।।

ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ মাহফিল ও কিয়াম সংক্রান্ত মাসআলা ৷

বিষয়ঃ
         মিলাদ মাহফিল ও কিয়াম সংক্রান্ত মাসআলা ৷

প্রশ্নঃ
       (১)এক জায়গায় সমবেত হয়ে যৌথ কন্ঠে প্রচলিত মিলাদ-মাহফিল জায়েজ কি?
(২) মিলাদের মাঝখানে হঠাৎ কিয়াম করার ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কী?
(৩) প্রচলিত মিলাদের আবিষ্কারক কে? কখন থেকে এই মিলাদের প্রচলন বা সূচনা হয়?

                            حامدا ومصليا ومسلما     

উত্তরঃ
          (১) না, এক জায়গার সমবেত হয়ে যৌথ কন্ঠে প্রচলিত মিলাদ-মাহফিল জায়েয নেই ৷

وفي الصحيح المسلم;رقم الحديث: ١٧١٨: عن عائشة قالت:  قال رسول الله صلي الله عليه وسلم: من أحدث في أمرنا هذا ماليس منه فهو رد.

وفي الجنة لأهل السنة (دهلي) ٢٠١: بحواله فتاوي محمودية؛٥/٣٦٤: لاأعلم هذا المولد أصلا في كتاب ولا سنة ولا ينقل عمله عن أحد من العلماء الأئمة الذين هم القدوة في الدين المتمسكون بآثار المتقدمين بل هو بدعة أحدثها البطلان وشهوة نفس اعتني بها الآكالون.

রেফারেন্স,
সহীহ মুসলীম;  হাদীস নং-১৭১৮, আল-জান্নাতু লিআহলিস সুন্নাহ; ২০১, আল-উরফুশ শাজী; ২৩১, কেফায়াতুল মুফতী; ১/১৪৭, ১৫১,

(২) মিলাদের মাঝখানে হঠাৎ কিয়াম করা বেদাআদ ও ভিত্তিহীন,  কুরআন-হাদীস অথবা শরয়ী কেন দলিল দ্বারা তা প্রমাণিত নয় ৷

وفي سنن أبي داؤد؛ ٢/٧١٠: باب الرجل يقوم للرجل يعظمه بذلك:  عن أبي أمامة قال: خرج رسول الله صلي الله عليه وسلم متكأ علي عصا. فقمنا له فقال:  لا تقوموا كما يقوم الأعاجم يعظم بعضها بعضا.

وفي السنن الترمذي؛ ٢/١٠٤: أبواب الاستيذان والأدب؛  باب ما جاء في كراهية قيام الرجل للرجل:  عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: لم يكن شخس أحب إليهم من رسول الله صلي الله عليه وسلم.  وكانوا إذا رأوه لم يقوموا لما يعلمون من كراهية ذلك .

রেফারেন্স,
সুনানে আবু দাউদ; ৭/১৭০, সুনানে তিরমিযী; ২/১৯৪, মুসনাদে আহমদ;৪/১২৬, সহীহ মুসলীম; ১৭১৮, কিতাবুন নাওয়াযেল;১/৫৫৫, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া; ৫ /৪১৪, ফাতাওয়া রশিদিয়া;১২০,

(৩) প্রচলিত মিলাদের আবিষ্কারক হলো,  বাদশাহ আবু সাঈদ মুজাফফার এবং সপ্তম শতাব্দীতে এর প্রচলন বা সূচনা হয় ৷

وفي الإيداع في مضار الابتداع؛ ١٢٦: (طبع مكتبة علمية مدينة المنورة)  بحواله فتاوي عثماني:  ١/١٠٥:( مكتبة معارع القرآني) وأول من أحدث المولد النبي بمدينة أربل الملك المظفر أبو سعيد في القرن السابع. قد استمر العمل بالمولد إلي يومنا هذا وتوسع الناس فيها وابتدعوا بكل متهواه أنفسهم ويوحيه إليهم الشيطان.

রেফারেন্স,
আল-ইদা'আ ফি মুদারিল ইবতিদা'আ;১২৬, আল-উরফুশ শাজী; ২৩১  ইখতিলাফে উম্মাত আওর সিরাতে মুস্তাকীম;৯৫, কেফায়াতুল মুফতী; ১/১৫১ , কিতাবুন নাওয়াযেল;১/৫৫১, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া:৫/৩৭৮,

والله أعلم بالصواب


হাদীস, টুপি মুসলিম উম্মাহর ‘শিআর’ জাতীয় নিদর্শন।

হাদীসে কি টুপির কথা নেই?

টুপি মুসলিম উম্মাহর ‘শিআর’ জাতীয় নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের যুগ থেকে প্রতি যুগে এর উপর ব্যাপকভাবে আমল ছিল। কিন্তু, যেমনটা আমি বিভিন্ন জায়গায় লিখেছি, ‘আমলে মুতাওয়ারাছে’র (উম্মাহর ও অবিচ্ছিন্ন কর্মের) সূত্রে বর্ণিত সুন্নাহ্র দলীল যখন সনদসহ বর্ণনারসূত্রে খোঁজ করা হয় তখন কখনো কখনো এমনও হয় যে, তা সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে পাওয়া যায় না যা পাওয়া যায় তার সনদ সহীহ হয় না। এ কারণে যারা দু’ চার কিতাবের দু’ চার জায়গায় দেখেই কোনো বিষয়কে ভিত্তিহীন বলে দিতে অভ্যস্থ তারা খুব দ্রুত এ ধরণের সুন্নাহকে অস্বীকার করে বসেন। টুপির ক্ষেত্রেও এ ব্যাপার ঘটেছে।
আযীযম মাওলানা ইমদাদুল হক কুমিল্লায়ী এ বিষয়ে কিছু হাদীস-আছার একত্র করেছে। এ বিষয়ে আরো দলিল আছে এবং এমন রেওয়ায়েতও আছে, যার সনদ সব রকমের আপত্তির উর্ধ্বে। এ প্রবন্ধ তার সংকলনের প্রথম ধাপ। অবশিষ্ট রেওয়ায়াত ইনশাআল্লাহ আগামী কোনো অবসরে পেশ করা হবে।-আব্দুল মালেক

‘‘টুপি পরা সুন্নত’’ কথাটি শৈশব থেকেই শুনে আসছি এবং সুন্নতের অনুসারী আলিম-উলামা ও দ্বীনদার মানুষকে তা পরতে দেখেছি। এই ব্যাপক অনুসৃত সুন্নাহর বিষয়ে কখনোই মনে সংশয় জাগেনি। একসময় উচ্চস্তরের পড়াশোনার জন্য গ্রাম থেকে চলে এলাম দেশের অন্যতম প্রাচীন ও বড় মাদরাসায়। সেখানে গিয়েই ছাত্রভাইদের কাছে প্রথম শুনলাম টুপি নিয়ে ভিন্ন কথা, সংশয় সন্দেহ। টুৃপি নাকি হাদীসে নেই। তাই কোনো কোনো আলেম তা পরেন না। শুধু রুমাল ব্যবহার করেন।
এদিকে কিছু প্রবাসী ভাই যারা আরব দেশগুলোতে থাকেন তারা এসে বলেন, আরবে নাকি টুপির গুরুত্ব বা রেওয়াজ নেই। খালি মাথায়ই তারা নামায পড়ে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সেই একই কথা-হাদীসের ভান্ডারে টুপির কথা নেই!
ইদানিং আবার আমাদের দেশে একটি মহল তৈরী হচ্ছে, যারা নির্দিষ্ট কিছু হাদীসের উপর আমল করে আর অন্যগুলোকে বিভিন্ন খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে এক প্রকার অস্বীকার করে। দ্বীনের অনেক স্বতসিদ্ধ বিষয় এবং নবী-যুগ থেকে অবিচ্ছিন্ন কর্মধারায় সর্বযুগে বিদ্যমান অনেক বিষয়কে স্থুল ও মুখরোচক কিছু অজুহাত দেখিয়ে ভ্রান্ত বলে আর নিজেদের ছাড়া অন্য সকলকে বাতিল বলতে থাকে। ওদের তরফ থেকেও ‘টুপি নেই’ জাতীয় কথা মিডিয়াতেও প্রচারিত হয়েছে। এসব কারণে এ বিষয়ে কিছু কিতাব ঘাঁটাঘাঁটি করলাম যা কিছু সংগ্রহ হল পাঠক মহলের নিকট পেশ করার ইচ্ছা করলাম।
টুপি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরেছেন, সাহাবায়ে কেরাম পরেছেন, তাবেয়ীন তাবে-তাবেয়ীন পরেছেন এবং পরবর্তীতে সব যুগেই মুসলিমগণ তা পরিধান করেছেন। টুপি, পাগড়ীর মতোই একটি ইসলামী লেবাস। হাদীসে, আছারে ও ইতিহাসের কিতাবে এ বিষয়ে বহু তথ্য আছে এবং অনেক আলিম-মনীষীর বক্তব্য আছে। এমন প্রতিষ্ঠিত একটি বিষয়কেও যারা ভিত্তিহীন মনে করেন তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উপর সত্যিই করুণা হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু দলীল পেশ করছি। প্রথমে হাদীস থেকে।
হাদীস-১
হাসান বিন মেহরান থেকে বর্ণিত-
عن رجل من الصحابة : قال : أكلت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، ورأيت عليه قلنسوة بيضاء
 একজন সাহাবী বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তাঁর দস্তরখানে খেয়েছি এবং তাঁর মাথায় সাদা টুপি দেখেছি’ (আল ইসাবাহ ৪/৩৩৯)
এ হাদীসটি ইমাম ইবনুস সাকান তার কিতাবুস সাহাবায় সনদসহ বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর এ বর্ণনায় সাহাবীর নাম আসেনি। তা এসেছে তাঁর অন্য বর্ণনায় এবং ইমাম বুখারী ও ইমাম আবু হাতেমের বর্ণনায়। তাঁর নাম ফারকাদ। (দ্র. আততারীখুল কাবীর ৭/১৩১; কিতাবুল জারহি ওয়াত তা’দীল ৭/৮১) উল্লেখ্য, ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. ইমাম ইবনুস সাকানের উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা আবু নুআইম আল আসবাহানী রহ.এর এ দাবি খন্ডন করেছেন যে, ফারকাদ সাহাবী আল্লাহর নবীর দস্তরখানে খাবার খাননি। বরং হাসান ইবনে মেহরান খাবার খেয়েছেন সাহাবী ফারকাদের সাথে। (মারিফাতুস সাহাবা ৪/১০৪)
হাফেজ ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ ক্ষেত্রে আবু নুআইমই ভুলের শিকার হয়েছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি ইমাম ইবনুস সাকানের উপরোক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করেন। এতে প্রমাণিত হয় এ বর্ণনা সহীহ। অন্যথায় প্রমাণ-গ্রহণ শুদ্ধ হতো না। এবং আবু নুআইম এর মত ইমাম এর কথাকে খন্ডন করা যেত না।
তাছাড়া সাহাবী ফারকাদ রা.এর আল্লাহর নবীর দস্তরখানে খাবার খাওয়ার কথা ইমাম বুখারী, ইমাম আবু হাতেম ও ইবনু আবদিল বারও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।

হাদীস-২
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন
أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يلبس من القلانس في السفر ذوات الآذان، وفي الحضر المشمرة يعني الشامية.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর অবস্থায় কান বিশিষ্ট টুপি পরতেন আর আবাসে শামী টুপি পরতেন। (আখলাকুন নুবুওয়্যাহ, আল জামে লি আখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে পৃ. ২০২)
এ হাদীসের সকল রাবী ‘‘ছিকা’’। উরওয়া ও হিশাম তো প্রসিদ্ধ ইমাম। আর মুফাদদাল ইবনে ফাদালা নামে দুইজন রাবী আছেন। একজন মিসরী, তিনি অনেক বড় ইমাম ছিলেন। মিসরের কাযী ছিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে তিনি ‘‘ছিকা’’। আসমাউর রিজালের কিতাবাদি থেকে প্রতীয়মান হয় সনদে উল্লেখিত ব্যক্তি ইনিই। কারণ তিনিই হিশাম ইবনে উরওয়া ও ইবনে জুরাইজ থেকে রেওয়ায়েত করেন যা আল্লামা ইবনে আদী ও আল্লামা মুহাম্মাদ বিন হাসান বিন কুতায়বা তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। (আল-কামিল ৭/৪০৯ ইকমালু তাহযীবিল কামাল ১১/৩৩৮)
অপর জন বসরী। তাঁর স্মৃতিশক্তির বিষয়ে কিছু আপত্তি থাকলেও ইবনে হিববান তাকে ছিকা রাবীদের মধ্যে গণ্য করেছেন।
আবু হাতেম বলেছেন يكتب حديثه
আর ইমাম ইবনে আদী তার একটি বর্ণনাকে ‘মুনকার’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাকিগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন-
‘তার অন্য বর্ণনাগুলো সঠিক।’ সুতরাং সনদে উল্লেখিত রাবী যদি বসরীও হন তবুও তার এ বর্ণনা সঠিক।
হাদীস-৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, একবার আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে একজন আনসারী সাহাবী তাঁর কাছে এলেন। এবং তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি ফিরে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আনসারী! আমার ভাই সাদ ইবনে উবাদাহ কেমন আছে? আনসারী বললেন, ভাল আছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের কে কে তাকে দেখতে যাবে? অতপর তিনি দাঁড়ালেন আমরাও দাঁড়ালাম। আমরা সংখ্যায় দশের অধিক হব। আমাদের পায়ে মোজাও ছিল না। চপ্পলও না। গায়ে জামাও ছিল না, টুপিও না। ঐ কংকরময় ভূমিতে আমরা চলছিলাম। অবশেষে আমরা সাদ এর নিকট পৌঁছলাম তখন তার পাশ থেকে মানুষজন সরে গেল। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীরা প্রবেশ করলেন।
এখানে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এর বাক্য ‘‘আমাদের পায়ে মোজাও ছিল না, চপ্পলও না। গায়ে জামাও ছিল না টুপিও না’’ থেকে বোঝা যায়, ঐ যুগে টুপিও ছিল লিবাসের অংশ এবং কোথাও যাওয়ার জন্য সেগুলো রীতিমত আবশ্যকীয় এর ন্যয় ছিল। তাই এখানে এগুলো না থাকায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর তা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টি ঠিক এরকম যেমন ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারীতে বুরনুস প্রমাণ করেছেন। সহীহ বুখারীতে কিতাবুল লিবাসে باب البرانس নামে শিরোনাম দাঁড় করেছেন আর দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন হজের একটি হাদীস।
لا يلبس المحرم القميص ولا العمائم ولا البرانس
 ‘‘ইহরাম গ্রহণকারী জামাও পরবে না, পাগড়ীও না, বুরনুস (এক প্রকার টুপি)ও না।’’
আল্লামা আবু বকর ইবনুল আরাবী এ হাদীস থেকে পাগড়ী প্রমাণ করেছেন। তিনি বলেন, এ হাদীস প্রমাণ করে যে, তৎকালে পাগড়ী পরিধানের রীতি ছিল। এ কারণে ইহরাম অবস্থায় তা পরিধান করা নিষেধ করেছেন।
একইভাবে আলোচিত হাদীস দ্বারাও টুপি ও তার প্রচলন প্রমাণে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
হাদীস -৪
উমর ইবনে খাত্তাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-
الشهداء ثلاثة : رجل مؤمن ... ورفع رسول الله صلى الله عليه وسلم رأسه حتى وقعت قلنسوته أو قلنسوة عمر.
শহীদ হল তিন শ্রেণীর লোক : এমন মুমিন ... এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা তুললেন। তখন তাঁর টুপি পড়ে গেল। অথবা বলেছেন উমরের টুপি পড়ে গেল। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৪৬ জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৬৪৪ ইত্যাদি)
হাদীসটির ক্ষেত্রে ইমাম তিরমিযী বলেছেন, ‘হাসানুন গারীবুন।’
হাদীসটির সনদ এই,
عن عبد الله بن لهيعة عن عطاء بن دينار أبي يزيد الخولاني عن فضالة بن عبيد عن عمر بن الخطاب رضي الله عنهم
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে লাহিয়া এর ক্ষেত্রে যদিও মুহাদ্দিসীনদের বিভিন্ন রকম বক্তব্য আছে, কিন্তু এ হাদীসটি তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক। আর এক্ষেত্রে ইমামগণ এক মত যে ইবনে লাহিয়া থেকে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক কর্তৃক বর্ণনাকৃত হাদীসগুলো সঠিক।
উপরন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে লাহিয়ার একজন ‘মুতাবি’ও আছেন সায়ীদ ইবনে আবী আইয়ূব। যা ইমাম বুখারী ও ইমাম আবু হাতিম এর কথায় পাওয়া যায়।
قال الترمذي : سمعت محمدا يقول : قد روى سعيد بن أبي أيوب هذا الحديث عن عطاء بن دينار عن أشياخ من خولان، ولم يذكر فيه عن أبي زيد.
وقال أبو حاتم : وروى سعيد بن أبي أيوب عن عطاء بن دينار عن أشياخ من خولان عن فضالة عن عمر.
আর এ সনদের আরেকজন রাবি, আবু ইয়াযিদ আল খাওলানী। মুতাআখখিরীনদের মাঝে কেউ কেউ তাকে মাজহ
মাজহুল বলেছেন।
এক্ষেত্রে প্রথম কথা এই যে, হাদীসটি শুধু তিনিই বর্ণনা করেননি; বরং খাওলান শহরের আরো অনেক মুহাদ্দিস তা বর্ণনা করেন, যা ইমাম বুখারী ও ইমাম আবু হাতেম এর উপরোক্ত কথায় পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় কথা এই যে, ইমাম বুখারী, ইমাম আবু হাতেম, ইমাম তিরমিযীসহ মুতাকাদ্দিমীন ইমামগণের কেউ তাকে মাজহুল বলেন নি; বরং সকলে তাঁর জীবনীতে তাঁর নাম উল্লেখ করে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। কেউ তাঁর সম্পর্কে ভালোও বলেননি মন্দও বলেননি। এটাকে হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় বলা হয় سكوت المتكلمين في الرجال অর্থাৎ ইমামগণের নীরব থাকা। এই কারণে রাবী মাজহুল হওয়া আবশ্যক নয় বরং এটাকে এক প্রকার তা’দীল হিসেবে ধরা হয়। বিশেষত রাবী যদি তাবেয়ী স্তরের হন। আর এখানেও তা ঘটেছে। সম্ভবত এ নিশ্চুপ থাকাকেই পরবর্তীদের কেউ মাজহুল বলে দিয়েছেন, যা ঠিক নয়।
থাকল এ বিষয় যে, উপরোক্ত হাদীসে কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর টুপি সম্পর্কে বলা হয়েছে না ওমর রা.এর টুপি সম্পর্কে? যদি ধরেও নেয়া হয় যে, ওমর রা. এর টুপি সম্পর্কে তাহলেও তো একজন খলীফায়ে রাশেদের টুপি পরা প্রমাণিত হচ্ছে। আর খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্রই অংশ, বিশেষত যখন একাধিক হাদীসে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরও টুপি পরা প্রমাণিত হচ্ছে।
আপাতত এ চারটি হাদীস উল্লেখ করা হল। হাদীসের কিতাবসমূহে এ বিষয়ে আরো হাদীস আছে এবং টুপি নিয়ে আলাদা শিরোনামও আছে। আসহাবুস সিয়ার তথা সীরাত প্রণেতা ইমামগণও আল্লাহর নবীর পোষাকের অধ্যায়ে তাঁর টুপির জন্যও আলাদা পরিচ্ছেদ কায়েম করেন। যেমন করেছেন ইবনে হাইয়ান, ইবনুল কায়্যিম, ইবনে আসাকির, ইবনুল জাওযী, গাযালী, শায়খ ইউসুফ সালেহী, আল্লামা দিময়াতী, বালাযুরীসহ আরো অনেক ইমাম। সকলের বক্তব্য তুলে ধরলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে তাই শুধু আল্লামা  ইবনুল কায়্যিম রহ. এর বক্তব্য তুলে ধরছি। তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘‘যাদুল মাআদে’’ লেখেন, তাঁর একটি পাগড়ি ছিল, যা তিনি আলী রা. কে পরিয়েছিলেন। তিনি পাগড়ি পরতেন এবং পাগড়ির নিচে টুপি পরতেন। তিনি কখনো পাগড়ি ছাড়া টুপি পরতেন। কখনো টুপি ছাড়াও পাগড়ি পরতেন। (যাদুল মাআদ ১/১৩৫)
সাহাবায়ে কেরামের টুপি
জানা কথা যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টুপি পরেছেন তখন সাহাবায়ে কেরামও পরবেন। বরং কোনো হাদীসে আল্লাহর নবীর টুপির উল্লেখ না এলেও যদি সাহাবায়ে কেরামের টুপি পরা প্রমাণিত হয় তাহলে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর টুপি পরিধানেরই প্রমাণ বহন করবে। হাদীস ও আছারের কিতাবে সাহাবায়ে কেরামের টুপি পরার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে একটি পুস্তিকা হয়ে যাবে। এখানে সামান্য কিছু বর্ণনা উল্লেখ করা হল।

1.            হাসান বসরী রাহ. বলেন,
وكان القوم يسجدون على العمامة والقلنسوة
তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম গরমের দিনে) পাগড়ি বা টুপির উপর সিজদা করতেন।-সহীহ বুখারী, কিতাবুস সালাত ‘প্রচন্ড গরমের কারণে কাপরের উপর সিজদা করা’ অধ্যায়।
উল্লেখ্য, হাসান বসরী রাহ. অনেক বড় মনীষী তাবেয়ী, যিনি অনেক সাহাবীকে দেখেছেন এবং তাদের সাহচর্য গ্রহণ করেছেন।
2.            সুলাইমান ইবনে আবি আবদিল্লাহ বলেন,
أدركت المهاجرين الأولين يعتمون بعمائم كرابيس سود وبيض وحمر وخضر وصفر، يضع أحدهم العمامة على رأسه ويضع القلنسوة فوقها، ثم يدير العمائم هكذا على كوره لا يخرجها من ذقنه
আমি প্রথম সারির মুহাজিরগণকে দেখেছি তাঁরা সুতির পাগড়ি পরিধান করতেন। কালো, সাদা, লাল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি রংয়ের। তারা পাগড়ির কাপড় মাথায় রেখে তার উপর টুপি রাখতেন। অতপর তার উপর পাগড়ি ঘুরিয়ে পরতেন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১২/৫৪৫
3. হেলাল ইবনে ইয়াসাফ বলেন,
قدمت الرقة فقال لي بعض أصحابي : هل لك في رجل من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم؟ فقلت : غنيمة. فدفعنا إلى وابصة، فقلت  لصاحبي : نبدأ فننظر إلى دله فإذا عليه قلنسوة لا طية ذات أذنين.
আমি রাক্কায় গিয়েছিলাম তখন আমার এক সাথী আমাকে বললেন, তুমি কি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাললাম-এর একজন সাহাবীর নিকট যেতে ইচ্ছুক? আমি বললাম, ‘এ তো গনীমত।’ তারপর আমরা ওয়াবেছা রা.-এর নিকট গেলাম। আমি আমার সাথীকে বললাম, দাঁড়াও, প্রথমে আমরা তাঁর আচার-আখলাক দেখব। তাঁর মাথায় দুই কান বিশিষ্ট টুপি ছিল, যা মাথার সঙ্গে মিশে ছিল।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৯৪৯
4.    হিশাম বলেন,
رأيت على ابن الزبير قلنسوة
আমি ইবনে যুবায়ের রা.-এর মাথায় টুপি দেখেছি।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৩৫৩
5.    আশআছ রাহ. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন-
أن أبا موسى خرج من الخلاء وعليه قلنسوة،
আবু মুসা আশআরী রা. হাম্মাম থেকে বের হলেন। তার মাথায় টুপি ছিল।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১০/৫১০
6.   আববাদ ইবনে আবী সুলাইমান বলেন,
رأيت على أنس بن مالك قلنسوة بيضاء
আমি আনাস ইবনে মালেক রা.-এর  মাথায় একটি সাদা টুপি দেখেছি।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৫/১২১
7.    আবু হাইয়ান বলেন,
كانت قلنسوة علي لطيفة
হযরত আলী রা.-এর টুপি ছিল পাতলা।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৩/২৩
ইবনে সাদ আলী রা.-এর জীবনীতে তাঁর পোশাকের আলোচনায় তার টুপি সম্পর্কে আলাদা শিরোনাম এনেছেন।
8.    আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. মাথা মাসাহর সময় টুপি উঠিয়ে নিতেন এবং অগ্রভাগ মাসাহ করতেন।-সুনানে দারা কুতনী, হাদীস : ৫৫; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস : ২৮৮
9.    ফাযারী রাহ. বলেন,
10.  رأيت على علي قلنسوة بيضاء مصرية
আমি আলী রা.-এর মাথায় সাদা মিসরী টুপি দেখেছি।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৩/২৩
11. সায়ীদ ইবনে আবদুল্লাহ বলেন,
رأيت أنس بن مالك أتى الخلاء، ثم خرج وعليه قلنسوة بيضاء مزرورة
আমি আনাস ইবনে মালেক রা. কে দেখেছি, তিনি হাম্মাম থেকে বের হলেন। তার মাথায় বোতাম বিশিষ্ট সাদা টুপি ছিল।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ১/১৯০
12. আবদুল হামীদ বিন জাফর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. ইয়ারমূক যুদ্ধের দিন তার একটি টুপি হারিয়ে ফেললেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তা পাওয়া গেল। তা ছিল একটি পুরানো টুপি। খালেদ রা. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরার  পর মাথা মুন্ডন করলেন। সাহাবীগণ তাঁর চুল নেওয়ার জন্য ছুটতে লাগলেন। আমি গিয়ে তাঁর মাথার অগ্রভাগের চুলগুলি পেলাম। তা এ টুপিতে লাগিয়ে রেখেছি। যে যুদ্ধেই এ টুপি আমার সাথে ছিল তাতেই আল্লাহর সাহায্য পেয়েছি।-দালাইলুন নুবুওয়াহ ৬/২৪৯
সাহাবায়ে কেরামের টুপি ব্যবহারের প্রমাণ স্বরূপ আপাতত এ কয়টি আছার উল্লেখ করা হল। প্রথম দুই বর্ণনা ব্যাপকভাবে সাহাবায়ে কেরামের টুপি ব্যবহারের প্রমাণ বহন করছে। আর পরবর্তী বর্ণনাগুলোতে অনেক সাহাবীর টুপি ব্যবহার উল্লেখিত হয়েছে। টুপির শুধু ব্যবহার নয়, ব্যাপক প্রচলন এ বর্ণনাগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি বর্ণনা উল্লেখ করে তাবেয়ী-যুগের বর্ণনায় যাব, যার পর অতি সংশয়গ্রস্ত লোকেরও সংশয় থাকা উচিত নয়।

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা.-এর যুগে যখন ‘নাজরান’ শহরের খৃস্টানরা সন্ধিতে রাজি হল এবং কর দিতে সম্মত হল তখন তারা হযরত উমর রা.-এর সাথে একটি চুক্তিনামা করেছিল। সেই চুক্তির অংশবিশেষ এই-
بسم الله الرحمن الرحيم، هذا كتاب لعبد الله عمر أمير المؤمنين من نصارى مدينة كذا كذا، لما قدمتم سألناكم الأمان لأنفسنا وذرارينا وأهل ملتنا وشرطنا لكم على أنفسنا أن لا نحدث في مدينتنا ولا فيما حولها ديرا ولا كنيسة ... ولا نتشبه بهم (المسلمين) في شيء من لباسهم من قلنسوة ولا عمامة.
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
এ অমুক শহরের নাসারাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর বান্দা আমীরুল মুমিনীন উমরের সাথে লিখিত চুক্তি। যখন আপনারা (মুসলমানগণ) আমাদের শহরে এলেন তখন আমরা আপনাদের নিকট আমাদের, আমাদের সন্তান-সন্ততি ও স্বধর্মের লোকদের জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করেছি। আমরা নিজেদের উপর এ শর্ত গ্রহণ করছি যে, এ শহরে এবং এর আশপাশে আমরা কোনো গির্জা তৈরি করব না ... এবং আমরা মুসলমানদের পোশাক-টুপি, পাগড়ি ইত্যাদিতে সাদৃশ্য গ্রহণ করব না ...।-সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস : ১৯১৮৬
চুক্তিনামার এ অংশে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় :
এক. টুপিকে মুসলমানদের পোশাক বলা হয়েছে। যেমন পাগড়িকে বলা হয়েছে। একটি বস্ত্তর কতটুকু প্রচলন হলে তা একটি দল বা গোষ্ঠীর সাথে সম্বন্ধ করা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দুই. টুপিকে একটি রাষ্ট্রীয় চুক্তিনামায় উল্লেখ করা দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়, সে যুগে মুসলমানদের নিকট টুপির গুরুত্ব কেমন ছিল এবং তার প্রচলন কত ব্যাপক ছিল।
তিন. এ চুক্তিনামা যখন লেখা হয় তখন বহু সাহাবী জীবিত ছিলেন। ইতিহাসে এমন একটি বর্ণনাও নেই যে, তাদের কেউ এ বিষয়ে আপত্তি করেছেন; বরং পরবর্তী খলীফাগণও এ চুক্তি বলবৎ রেখেছেন। এমনকি হযরত আলী রা.-এর যুগে এ নাসারারা এ চুক্তির কোনো একটি বিষয়ে কথা বলতে এসেছিল। তখন তিনি তাদেরকে সাফ বলে দেন-
إن عمر كان رشيد الأمر، لن أغير شيئا صنعه عمر
নিশ্চয়ই উমর সঠিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি যা করেছেন আমি তার কিছুই কোনোরূপ পরিবর্তন করতে পারব না।
হযরত উমর রা.-এর এ চুক্তিনামাটিকে যিম্মীদের ক্ষেত্রে শরীয়তের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উসূল বা মানদন্ড হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তী যুগের আলিম-মনীষী ও মুসলিম খলীফাগণ যিম্মিদের সাথে কোনো চুক্তিনামা করলে এর শর্তগুলোকে মানদন্ড হিসেবে সামনে রাখতেন।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. বলেন, এ শর্তগুলো এতই প্রসিদ্ধ যে, এগুলোর সনদ উল্লেখের প্রয়োজন নেই। কেননা ইমামগণ তা সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন ও এগুলো দ্বারা প্রমাণ গ্রহণ করেছেন। আর হযরত উমর রা.-এর এসব শর্ত ছিল তাঁদের কিতাবে ও মুখে মুখে। পরবর্তী খলীফাগণ তা বলবৎ রেখেছেন এবং এর অনুসরণ করেছেন। -আহকামু আহলিয যিম্মাহ, পৃষ্ঠা : ৪৫৪
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. এ কিতাবটি শুধু হযরত উমর রা.-এর এ চুক্তিনামার শরহ বা ব্যাখ্যাতেই প্রণয়ন করেছেন।
যাহোক, উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, সকল যুগেই টুপি মুসলমানদের পোশাক ছিল। আশা করি, খিলাফতে রাশিদা-যুগের এ চুক্তিনামা দেখার পর কারো কোনো সংশয় থাকবে না। কোনো হাদীস বা আছারে টুপির কথা উল্লেখিত না হলেও এ দলীলটি আলোচ্য বিষয়ে যথেষ্ট হত।

তাবেয়ীগণের টুপি
যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টুপি পরেছেন, সাহাবায়ে কেরাম পরেছেন এবং তা ছিল মুসলিমদের পোশাকের অংশ তখন জানা কথা, তাবেয়ীগণও তা পরেছেন। উপরের আলোচনা থেকেই তাবেয়ীন-যুগও পরবর্তী যুগেও মুসলিম-সমাজে টুপির সুন্নাহ প্রতিষ্ঠিত থাকা প্রমাণিত হয়। তাই আলাদাভাবে তাবেয়ীদের টুপি প্রমাণের আর প্রয়োজন থাকে না। এরপরও কিছু নমুনা পেশ করছি।
1.    আবদুল্লাহ ইবনে আবি হিন্দ রাহ. বলেন,
رأيت على علي بن الحسين قلنسوة بيضاء لاطئة
আমি আলী ইবনে হুসাইন রাহ.-এর মাথায় একটি সাদা টুপি দেখেছি, যা মাথার সাথে মিলিত ছিল।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৩/২৪৩
2.   আবুল গুছ্ন বলেন-
رأيت نافع بن جبير يلبس قلنسوة سماطا وعمامة بيضاء
আমি নাফে ইবনে জুবাইরকে পুঁতিবিশিষ্ট টুপি ও সাদা পাগড়ি পরতে দেখেছি।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৫/২০৬ (শামেলা)
3.      খালেদ ইবনে বকর বলেন,
رأيت على سالم قلنسوة بيضاء
আমি সালেম রাহ.-এর মাথায় সাদা টুপি দেখেছি। (সালেম হলেন সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর পুত্র)।-তবাকাতে ইবনে সাআদ ৫/১৯৭; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/৪৬৪ (শামেলা)
4.    আইয়ূব বলেন,
رأيت على القاسم بن محمد قلنسوة من خز
আমি কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ রাহ.-এর মাথায় পশমের টুপি দেখেছি।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৫/১৮৯; হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/১৮৫ (শামেলা)
5.      মুহাম্মাদ ইবনে হিলাল বলেন,
رأيت سعيد بن المسيب يعتم وعليه قلنسوة لطيفة بعمامة بيضاء
আমি সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িবকে একটি পাতলা টুপির উপর পাগড়ি বাঁধতে দেখেছি।-তবাকাতে ইবনে সাদ, ৫/১৩৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/২৪২ (শামেলা)
6.      কাসিম ইবনে মালিক এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন-
رأيت على الضحاك قلنسوة ثعالب
অর্থ : আমি যাহহাক রাহ.-এর মাথায় একটি চামড়ার টুপি দেখেছি।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৬/৩০১ (শামেলা)
7.      যুহাইর বলেন,
رأيت أبا إسحاق السبيعي وهو يصلي بنا، يأخذ قلنسوته من الأرض فيلبسها أو يأخذها عن رأسه فيضعها.
আমি আবু ইসহাক আসসাবীয়ীকে দেখেছি তিনি আমাদের নিয়ে নামায পড়েছেন। তিনি টুপি খুলে মাটিতে রাখছেন কিংবা তা উঠিয়ে মাথায় পরছেন।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৬/৩১৪ (শামেলা)
8.      ইয়াযিদ ইবনে আবী যিয়াদ রাহ. বলেন,
رأيت إبراهيم النخعي يلبس قلنسوة ثعالب
আমি ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর মাথায় চামড়ার টুপি দেখেছি।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৬/২৮০ (শামেলা)
9.      আবুল হাইসাম আলকাসসাব বলেন, আমি ইবরাহীম নাখায়ীর মাথায় তায়লাসার টুপি দেখেছি, যার অগ্রভাগে চামড়া ছিল।-প্রাগুক্ত
10.   বাক্কার ইবনে মুহাম্মাদ বলেন, আমি ইবনে আউস-এর মাথায় একটি টুপি দেখেছি, যা এক বিঘত উঁচু ছিল।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৭/২৬৭ (শামেলা)
11.   ফযল ইবনে দুকাইন বলেন, আমি দাউদ আততায়ীকে দেখেছি। তাঁর টুপি আলিমগণের টুপির মতো ছিল না। তিনি কালো লম্বা টুপি পরতেন, যা ব্যবসায়ীরা পরে থাকে।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৬/৩৬৭ (শামেলা)
12.   ইমাম মালেক বলেন, আমি রবীয়া ইবনে আবদুর রহমান আররায়ীর মাথায় একটি টুপি দেখেছি, যার বাইরে ও ভেতরে রেশমজাতীয় কাপড় ছিল।-তবাকাতে ইবনে সাদ (আলকিসমুল মুতাম্মিম) ১/৩২১ (শামেলা)
13.  শুআইব ইবনে হাবহাব বলেন, প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবুল আলিয়ার একটি টুপি ছিল, যার পাটের ভিতর চামড়া ছিল।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৭/১১৬ (শামেলা)
14.   আফফান ইবনে মুসলিম বলেন, আবু আওয়ানা টুপি পরতেন।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৭/২৮৭ (শামেলা)
15.   আফফান ইবনে মুসলিম বলেন, হাম্মাদ ইবনে যায়েদ একটি সাদা পাতলা লম্বা টুপি পরতেন।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৭/২৮৬ (শামেলা)
16.  হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ.-এর শাহাদতের ঘটনায় আছে, যখন হাজ্জাজ জল্লাদকে বলল, তার গর্দান উড়িয়ে দাও তখন সে তা করল (নাউযুবিল্লাহ)। সায়ীদ ইবনে জুবাইর এর শীর একদিকে ছিটকে পড়ল। তখন তার মাথার সাথে একটি সাদা টুপি মিলিত ছিল।-তবাকাতে ইবনে সাদ ৬/২৬৫ (শামেলা)
17.   হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা বলোনি, শরীক ইবনে আবদুল্লাহ আমাদের নিয়ে জানাযার নামায পড়লেন এবং তার টুপিকে সুতরা হিসেবে সামনে রাখলেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৬৯১
উল্লেখ্য, কারো কারো ধারণা, ঐ যুগে টুপি এত লম্বা ছিল যে, তা দিয়ে সুতরাও দেওয়া যেত। আসলে তা নয়। সুতরার ক্ষেত্রে এ কথাও আছে যে, সুতরা দেওয়ার মতো কোনো কিছু পাওয়া না গেলে কমপক্ষে একটি রেখা হলেও যেন টেনে দেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই তারা রেখা না টেনে কমপক্ষে টুপিটা হলেও রাখতেন। যেন কিছু একটা রাখা হয়। এটা টুপি লম্বা হওয়া বা ছোট হওয়া আবশ্যক করে না।
তাবেয়ীনের টুপি সম্পর্কে আপাতত এ কয়েকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হল।
বিজ্ঞ পাঠক আমাদের বরাতগুলো দেখে সম্ভবত অনুমান করতে পেরেছেন যে, হাদীস ও তারীখের দু’ চারটি কিতাব থেকেই তা সংগ্রহ করা হয়েছে। যদি হাদীস-আছার ও তারীখের কিতাবাদিতে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয় তাহলে এ বিষয়ে বিশাল সংগ্রহ প্রস্ত্তত হবে। কিন্তু আমরা এখানে এতটুকুই যথেষ্ট মনে আমরা এখানে সতেরজন তাবেয়ীর বরাত উল্লেখ করেছি। এদের মধ্যে আছেন হুসাইন রা.-এর পুত্র, যিনি আহলে বাইতের একজন। আছেন সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর, যিনি মক্কা নগরীর ফকীহদের একজন। আরো আছেন সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব ও সায়ীদ ইবনে জুবাইর এবং ইবরাহীম নাখায়ীর মতো অকুতোভয় ফকীহ ইমাম।
তাঁদের মতো মনীষী ব্যক্তিত্ব কোনো বিষয়ে একমত হবেন আর তা নবী ও সাহাবীদের যুগে থাকবে না তা কি চিন্তা করা যায়?

মুজতাহিদ ইমামগণের টুপি
মুজতাহিদ ইমামগণ হলেন কুরআন-সুন্নাহর ভাষ্যকার এবং কুরআন-সুন্নাহর বিধানের সংকলক। গোটা মুসলিম জাহানের অধিকাংশ মুসলিম তাঁদের ব্যাখ্যা অনুসারেই কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমল করেন। তাই তাদের টুপি ব্যবহারের বিষয়টিও উল্লেখ করছি।
ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর টুপি
ইমাম আবু হানীফা উঁচু টুপি পরতেন।-আলইনতিকা, পৃষ্ঠা : ৩২৬; উকুদুল জুমান, পৃষ্ঠা : ৩০০-৩০১
ইমাম মালিক রাহ.-এর টুপি
كان مالك بن أنس إذا أراد أن يخرج يحدث توضأ وضوءه للصلاة ... ولبس قلنسوته ومشط لحيته ...
অর্থ : ইমাম মালেক রাহ. যখন হাদীস বর্ণনার জন্য বের হতেন তখন অযু করতেন, টুপি পরতেন ও দাঁড়ি আঁচড়ে নিতেন।-আলজামে, খতীব বাগদাদী ১/৩৮৮, বর্ণনা : ৯০৩
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর টুপি
ফযল ইবনে যিয়াদ বলেন-
رأيت على أبي عبد الله (الإمام أحمد) ... عليه عمامة فوق القلنسوة ... وربما لبس القلنسوة بغير عمامة.
অর্থ : আমি ইমাম আহমদকে টুপির উপর পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। ... তবে কখনো কখনো তিনি পাগড়ি ছাড়া টুপি পরেছেন।-সিয়ারু আলামিন নুবালা ১১/২২০ (শামেলা)
এ পর্যন্ত আমরা টুপির ক্ষেত্রে নবী-যুগ, সাহাবা-যুগ ও তাবেয়ী-যুগের ইতিহাস পেলাম। আল্লাহর রহমতে আমরা সংশয়হীনভাবে বুঝতে পারলাম যে, এসব যুগে টুপি ছিল এবং মুসলমানদের পোশাক হিসেবে অন্যান্য পোশাকের মতো টুপিরও ব্যাপক প্রচলন ছিল। বলাবাহুল্য, প্রত্যেক প্রজন্ম তার পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকেই দ্বীন শেখে।
সুতরাং তাবেয়ীন থেকে তাবে তাবেয়ীন তাদের থেকে তাদের পরবর্তীগণ এভাবে নবী-যুগ, সাহাবা-যুগের এ সুন্নাহ আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ের মতো এ বিষয়েও আমরা আমাদের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতের সাথে যুক্ত।
.

Popular Posts

একটু চিন্তা করুন ।

                      أعوذ بالله من الشيطان الرجيم                           بسم الله الرحمن الرحيم                 সকল মুসলিম ভাই বোন ক...

Search This Blog

Followers