কানাডায় গাড়ি হামলা,

সম্প্রতি কানাডার টরেন্টোতে এক গাড়ি হামলায় ১০ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন। এক দুবৃত্ত একটি ভ্যান নিয়ে ফুটপাথে উঠে পড়ে এবং পথচারীদের উপর দিয়ে চালিয়ে যেতে থাকে। এতে ভ্যানের নীচে চাপা পড়ে এবং এদিক সেদিক ছিটকে পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয় অ্যালেক মিনাসিয়ান নামক ২৫ বছরের এক যুবককে। হামলার সাথে সাথেই যথারীতি একে জঙ্গি হামলা বলে সন্দেহ করা হলেও কানাডিয়ান কতৃপক্ষ তদন্তের আগে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে। এরপর যে কারণটি উদ্ঘাটিত হয় তা বর্তমান জাহেলিয়াতেরই একটি নমুনা।
হামলার ঘটনার প্রধান তদন্তকারী গ্রাহাম গিবসন বলেন, হামলার শিকার বেশির ভাগই নারী। তাদের বয়স ২৫ থেকে ৮০ বছর। তিনি বলেন, ভর দুপুরে টরেন্টোর ব্যস্ত রাস্তায় পথচারীদের উপর গাড়ি তুলে দেয়ার আগে মিনাসিয়ান ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ঐ পোস্টে তিনি এলিয়ট রজার নামের এক ব্যক্তির প্রশংসা করেন এবং লেখেন, ‘ইনসেল বিদ্রোহ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমরা সব চ্যান ও স্টেসিসকে উৎখাত করব।’ এই দুর্বোধ্য বাক্যটি বিশ্লেষণ করতে গিয়েই কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে।
মিনাসিয়ান যার প্রশংসা করেছেন সেই এলিয়ট রজার ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইসলা ভিসতায় গুলি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছিল। লোকটি ছিল ভীষণ রকমের নারীবিদ্বেষী। মৃত্যুর আগে এক ভিডিওতে সে বলে যায়, নারীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে নিরাশ ছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিল নিঃসঙ্গতার জন্য সব নারীকে শাস্তি দিবে।
ইনসেল শব্দটি ‘ইনভলান্টারি সেলিবেটস’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। বাংলা করলে দাঁড়ায়-অনিচ্ছাকৃত কুমার। অর্থাৎ এ মতবাদে বিশ্বাসী পুরুষেরা নারীর সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াতে চায়। কিন্তু নারীদের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে নারী বিদ্বেষীতে পরিণত হয়। এই বিদ্বেষের প্রকাশ তারা ঘটায় নারীর প্রতি নানা সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তাদের ভাষায় নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সফল পুরুষেরা ‘চ্যান’। আর পুরুষদের প্রত্যাখ্যান করেন যেসব নারী তারা ‘স্টেসিস’।
বিদ্বেষপ্রসূত ঘৃণা নিয়ে কাজ করা সাদার্ন পোভার্টি ল সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে বলেছে, ২০১৪ সালে নিহত এলিয়ট রজার ছিল একজন স্বঘোষিত ইনসেল। তাকে অনুসরণ করা ইনসেলের সংখ্যাও কম নয়। অনলাইনে প্রায় ৪০ হাজার ইনসেলের একটি গ্রুপ আছে। তারা রজারকে ‘সেরা ভদ্রলোক’ ‘সাধু’, ‘নায়ক’ ও ‘ভাই’ বলে ডাকে। তার সব সহিংস কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে। এরা নারীর প্রতি গভীর সন্দেহ পোষণ করে। নারীদের অপমান করে আনন্দ পায়। নিজেদের যৌন-জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দায় নারীদের উপর চাপিয়ে স্বস্তি খোঁজে। তারা নারীকে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকে।  (দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল ২০১৮, পৃষ্ঠা ১৩)
যুগে যুগে ভোগবাদী ও জাহেলী সমাজ ব্যবস্থায় দেখা গেছে নারীর প্রতি একশ্রেণির পুরুষের এই আগ্রাসী মনোভাব। এখনো দেখা যাচ্ছে। ভোগবাদী পুরুষেরা নারীকে নিছক ভোগ্যবস্তুই মনে করে। এদের আগ্রাসী শ্রেণিটি নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, গ্রহণ-বর্জনের অধিকারকে আমলে নিতে চায় না। অথচ পুরুষের যেমন আছে ভালোলাগা-মন্দলাগার ব্যাপার তেমনি নারীরও  তা আছে। পুরুষের যেমন আছে পছন্দ-অপছন্দ তেমনি নারীরও আছে। কাজেই কোনো পুরুষের অবৈধ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের অধিকার যেমন একজন নারীর রয়েছে তেমনি রয়েছে বিবাহের বৈধ প্রস্তাবও  গ্রহণ না করার অধিকার। এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু ভোগবাদী সমাজ-ব্যবস্থায় নারীর এই অধিকার রক্ষিত হওয়া মোটেই সহজ নয়।
এই সমাজ-ব্যবস্থায় আগ্রাসী ও শক্তিশালী পুরুষদের নানা প্রকারের তৎপরতার মুখে নারীকে অসহায় হয়ে পড়তেই হয়। এই অসহায়ত্বের কত রূপ ও দৃষ্টান্ত যে আমাদের সমাজেও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তার হিসাব কে রাখে? শিক্ষকের হাতে ছাত্রীর, বসের হাতে নারী কর্মচারীর, পুরুষ সহকর্মীর হাতে নারী সহকর্মীর, রাজনৈতিক ক্ষমতাবান লোকদের হাতে নানা স্তরের নারীর, এমনকি বাসের ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের হাতে যাত্রী নারীর অসহায়ত্বের সংবাদ তো মাঝে মাঝেই পত্রিকার পাতায়  প্রকাশিত হচ্ছে।
নারীর প্রতি এই ব্যাপক ভোগবাদী আগ্রাসী মানসিকতার বিস্তারের পিছনে বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থার অবদানই সবচেয়ে বেশি। এখনকার গোটা লাইফস্টাইলটিই যেন আবর্তিত যৌনতাকে কেন্দ্র করে। পোষাক-পরিচ্ছদ, ফ্যাশন- বিনোদন, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য-সাংবাদিকতা, পর্ব-উৎসব, বিজ্ঞাপন, বাণিজ্য, আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম সবকিছুতেই যৌনতার ছড়াছড়ি। এই আবিল যৌনতাময় পরিবেশে যে প্রজন্মের মন-মানস গঠিত হচ্ছে তারা কীভাবে নারীকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে? কীভাবে নারীর স্বাভাবিক অধিকারকে মর্যাদা দিবে?
নারীর স্বাভাবিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সমাজে ভোগবাদী জীবন-দর্শনের পরিবর্তে স্বাভাবিক ও আখিরাতমুখী জীবন-দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থার অনুসরণ। এই জীবন-ব্যবস্থার মাঝেই যেমন আছে পুরুষের শান্তি ও স্বস্তির উপাদান তেমনি রয়েছে নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার নিশ্চয়তা।
সমাজে যখন নারী-পুরুষের উন্মুক্ত ও অবাধ মেলা-মেশার ধারা বহাল থাকে তখন স্বভাবতই কোমল ও দুর্বল শ্রেণি রুক্ষ ও শক্তিশালী শ্রেণির সামনে অসহায় হয়ে পড়ে- যদি না সেই শক্তিশালী শ্রেণিটির মাঝে তাদের চেয়েও শক্তিশালী কারো কাছে জবাবদিহিতার ভয় জাগ্রত করা যায়। এ কারণে সর্বস্তরে খোদাভীতির বিস্তারের পাশাপাশি সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাও জরুরি। একইসাথে নারীকেও যতটা সম্ভব এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া থেকে দূরে থাকার ব্যবস্থা গ্রহণ কাম্য। এই দিক থেকে চিন্তা করলে ইসলামের পর্দা বিধানের গুরুত্ব, যথার্থতা ও নারীর জন্য এর কল্যাণপূর্ণ হওয়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
টরেন্টো হামলায় নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে যে জাহেলী ও ভোগবাদী চিন্তা, যে হতাশা ও অশান্তির পরিচয় পাওয়া গেল এর যথার্থ ও স্বাভাবিক চিকিৎসা একমাত্র ইসলামেই রয়েছে। ক্ষোভ, বিদ্বেষ,  হতাশা ও হিং¯্রতার মতো আগুনে স্বভাবগুলোও শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে যেতে পারে ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে, যেমন হযরত ইবরাহীম আ.-এর জন্য নমরুদের প্রজ¦ালিত অগ্নিকু- আল্লাহ্র আদেশে শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে গিয়েছিল।
মানুষের মাঝে যখন আল্লাহ-মুখিতা ও আখিরাতমুখিতা তৈরি হয়, জীবনের এক উন্নত লক্ষ্যের সন্ধান যখন সে পেয়ে যায় তখন ক্ষণস্থায়ী জীবনের ভোগের আনন্দ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে না। জীবন তখন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে স্বাভাবিকতা ও ভারসাম্যের নরম আলোয়।
আহা! অ্যালেক মিনাসিয়ানের মতো তরুণেরা যদি পেত সেই আলোকিত জীবনের সন্ধান!!

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

একটু চিন্তা করুন ।

                      أعوذ بالله من الشيطان الرجيم                           بسم الله الرحمن الرحيم                 সকল মুসলিম ভাই বোন ক...

Search This Blog

Followers