বন্যা-পরিস্থিতি,


দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিস্তা ও যমুনার অববাহিকায় অবস্থিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন বন্যা কবলিত। একইভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার বহু এলাকার বন্যাপরিস্থিতিও দীর্ঘস্থায়ী রূপ গ্রহণ করেছে। এইসব অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছেন। বলাই বাহুল্য, দেশের জন্য এটি একটি দুর্যোগময় পরিস্থিতি। একদিকে এবারের ভারী বর্ষণ অন্যদিকে ভাটির দেশ হওয়ায় উজানের ঢলে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারার পানি বিপদজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বন্যাপরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্যমতে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার পানি কমানোর জন্য গত ৮ জুলাই থেকে তিস্তার গজল ডোবা বাঁধের গেট খোলা শুরু করে ভারতীয় কতৃপক্ষ। এর পরের তিন দিনে ক্রমান্বয়ে ৫৪ টি গেটের সবক’টিই খুলে দেয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের তিস্তা-অববাহিকার বিভিন্ন অঞ্চলে পানির প্রবল স্রাতে ভেঙ্গে যায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীর তীর-রক্ষা বাঁধ। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৬ জুলাই, পৃ. ১) উত্তর পূর্বাঞ্চলের অনেক নদ-নদীর মূল উৎসও ভারতে। ভারতের বরাক নদ আসামের করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় সুরমা ও কুশিয়ারা নামে ভাগ হয়েছে। এছাড়া সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তার পিয়াইল, ডাউকি ও সারি নদী, কোম্পানিগঞ্জের ধলাই নদ এবং কানাইঘাটের লোভা নদীর উৎস-নদীও ভারতের মেঘালয়ে অবস্থিত। একইভাবে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত জুড়ী নদী মৌলভীবাজারের জুড়ী ও কুলাউড়ার উপর দিয়ে হাকালুকি হাওর হয়ে সিলেটে ঢুকেছে। এ কারণে ভারতীয় অংশে বৃষ্টিপাত হলেই এসকল যৌথ নদীর মাধ্যমে পানি বাংলাদেশে বয়ে আসে। পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভারতীয় অংশে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে যৌথ নদীগুলো দিয়ে সেই পানি মাসখানেক ধরে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে। পরিবেশগত এই প্রতিকূলতার সাথে রয়েছে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা সংকট, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, উজান থেকে পানির সাথে বালু ও মাটি নেমে আসা ইত্যাদি। এসব কারণে এতদঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ ধারণ করে থাকে। বন্যায় গণমানুষের দুর্ভোগ সম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়েছে- ‘লাখ লাখ মানুষের ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, সড়ক যোগাযোগ বিপর্যস্ত, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় পানিবাহিত রোগ-ব্যাধি শুরু হয়েছে। বিশেষ করে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে শিশুরা। উপরন্তু বন্যার কারণে কৃষিকাজ ও অন্যান্য জীবিকা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ এখন বেকার। ‘এই পরিস্থিতি যদিও এখনো পর্যন্ত কয়েকটি জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তবু এটা একটা বড় দুর্যোগই বটে। কিন্তু এই দুর্যোগের শিকার কয়েক লাখ পরিবারের মানুষের জন্য যে ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। দৃষ্টান্ত স্বরূপ গাইবান্ধা জেলার ৫২ হাজার পরিবারের ২ লাখ ৯০ হাজার মানুষের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১৮ লাখ টাকা ও ৩২৫ মেট্রিক টন চাল। উপরন্তু এই ত্রাণ বিতরণে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ইতোমধ্যে খবর এসেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর বন্যাদুর্গত মানুষেরা ত্রাণ পাচ্ছে না।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ জুলাই, সম্পাদকীয়) যে কোনো পরিস্থিতি নতুন দায়-দায়িত্ব নিয়ে আসে। যেমন একটি পরিবারে একজন অসুস্থ হলে অসুস্থ ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্য সকলের উপর কিছু নতুন করণীয় সাব্যস্ত হয়। অসুস্থের কর্তব্য হয় ধৈর্য ধারণ করা ও সুস্থতার ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা আর অন্যদের কর্তব্য হয় অসুস্থের সেবা-শুশ্রূষা করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পরিবারের কেউ উপার্জনহীন হয়ে পড়লে এই নতুন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী ও তার চারপাশের সবার উপর কিছু নতুন দায়-দায়িত্ব বর্তায়। বস্তুত জীবন ও জগতে প্রতিনিয়ত অবস্থা ও পরিস্থিতির এই যে পরিবর্তন এর সাথে যুক্ত থাকে নতুন নতুন দায়-দায়িত্ব অর্পিত ও সাব্যস্ত হওয়ার ধারা। এই দায়িত্ব যিনি পালন করেন তিনি পরিস্থিতির ¯স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয়পাত্র হয়ে যান। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে দল-মত নির্বিশেষে সকলের কর্তব্য, বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল আহ্বান জানিয়েছেন- বন্যা নিয়ে রাজনীতি না করার। তবে শুধু রাজনীতই নয়, বন্যা নিয়ে দুর্নীতিও যেন না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। দুর্গত মানুষের ভোগান্তি নিয়ে রাজনীতি ও দুর্নীতি কোনোটাই কাম্য নয়। এইসব হীন মানসিকতা পরিহার করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রেরণা ও মানবিক চেতনা নিয়ে কাজ করা এখন সময়ের দাবি। একইসাথে বন্যা নিয়ন্ত্রণের টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের অরিপহার্য কর্তব্য। ইসলামী জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে সাধারণত এই সকল দায়িত্ব পালনকে একান্ত পার্থিব কাজ মনে করা হয় এবং কোনোভাবে পার্থিব দায়মুক্তিকেই যথেষ্ট মনে করা হয় অথচ এই সকল দায়িত্বপালনও ইসলামী পরিভাষায় আমানত রক্ষার অন্তর্ভুক্ত। যে আমানত সম্পর্কে আখিরাতে জবাবদিহী করতে হবে। এই দায়িত্বে অবহেলার কারণে তারা শুধু জনগণের কাছেই অপরাধী হবেন না, আল্লাহর কাছেও অপরাধী হবেন। পক্ষান্তরে স্ব স্ব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হবেন এবং তাঁর রহমত ও করুণা লাভে সমর্থ হবেন। আল্লাহ তাআলা সকলকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের প্রেরণা নিয়ে দায়িত্ব পালনের ও জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগের তাওফীক দান করুন। আমীন।

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

একটু চিন্তা করুন ।

                      أعوذ بالله من الشيطان الرجيم                           بسم الله الرحمن الرحيم                 সকল মুসলিম ভাই বোন ক...

Search This Blog

Followers