শবে বরাতে ইবাদতের ফযীলত বিষয়ে ঈসা আ. ও বুযুর্গ বৃদ্ধের কাহিনী,

১৫ই শাবানের রাত অর্থাৎ ১৪ই শাবান দিবাগত রাতকে ফার্সী, উর্দূ ও বাংলা ভাষায়  শবে বরাত বলা হয়। হাদীস শরীফে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান  হল, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোনো রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদ্যাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্যসব সাধারণ রাতের মত মনে করা এবং এ রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে তার সবগুলোকে ‘মওযূ’ বা ‘যঈফ’ মনে করা যেমন ভুল তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা। বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ি কোনোটিই উচিত নয়। যতটুকু ফযীলত প্রমাণিত এ রাতকে ততটুকুই গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং এ কেন্দ্রিক সকল মুনকার রসম-রেওয়াজ পরিহার করা উচিত। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন- মাসিক আলকাউসার-এর শাবান ১৪২৬ হি./ সেপ্টেম্বর ২০০৫ সংখ্যা ‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবে বরাত’; শাবান-রমযান ১৪২৯ হি./আগস্ট ২০০৮ সংখ্যা ‘শবে বরাত : কিছু ভ্রান্তি নিরসন’।

যাইহোক, এ রাতের ফযীলত বিষয়ে কিছু মানুষের মধ্যে যেমন ছাড়াছাড়ি রয়েছে তেমন বাড়াবাড়িও রয়েছে। আর এ বাড়াবাড়ি থেকেই এ বিষয়ক বিভিন্ন জাল বর্ণনা ও কিচ্ছা-কাহিনী সমাজে ছড়িয়েছে। সেগুলোর একটি হল- একদিন নাকি হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ! এ যামানায় আমার চেয়ে বুযুর্গ আর কেউ আছে কি? উত্তরে আল্লাহ বললেন, অবশ্যই; তুমি একটু সামনে অগ্রসর হও। ঈসা আলাইহিস সালাম চলতে লাগলেন। একটু পর প্রকা- এক গোলাকার পাথর দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। গায়েব থেকে আওয়াজ এল- হে ঈসা! তোমার হাতের আছা দ্বারা তাতে আঘাত কর। তিনি আঘাত করলেন। পাথরখ-টি দুই ভাগ হয়ে গেল। ঈসা আলাইহিস সালাম দেখতে পেলেন, তার মধ্যে তাসবীহ হাতে এক যঈফ বৃদ্ধলোক ইবাদাতে মগ্ন; তার সামনে একটি আনার পড়ে আছে।

ঈসা আলাইহিস সালাম জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে এবং কতদিন থেকে এখানে আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল আছেন? বৃদ্ধ বললেন, আমি এ এলাকারই একজন মানুষ। আমার মায়ের দুআয় আল্লাহ আমাকে এই বুযুর্গি দান করেছেন। ৪০০ বছর থেকে এই পাথরের মধ্যে বসে আমি আল্লাহ্র ইবাদতে মগ্ন আছি। আমার আহারের জন্য আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন জান্নাত থেকে একটি ফল পাঠিয়ে দেন।

এ কথা শুনে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সিজদায় পড়ে গেলেন; কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অপরাধী। আমি বুঝতে পেরেছি যে, এই ব্যক্তি আমার চেয়েও বুযুর্গ ও সম্মানী। তখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! জেনে রাখো- শেষ যামানার নবীর উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি শাবানের চাঁদের পনের তারিখে রাত জেগে ইবাদত করবে এবং দিনে রোযা রাখবে নিশ্চয় সে ব্যক্তি আমার নিকট এই বৃদ্ধের চেয়েও বেশি বুযুর্গ ও প্রিয় হতে পারবে। তখন ঈসা আলাইহিস সালাম কেঁদে কেঁদে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি যদি আমাকে নবী না বানিয়ে আখেরী যামানার নবীর উম্মত বানাতে তাহলে কতই না সৌভাগ্য হত আমার! তখন এক রাতে এত সওয়াব কামাই করতে পারতাম!

এ কিসসাটি কাজী মো: গোলাম রহমান কর্তৃক লিখিত ‘মকছুদোল মো’মেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জি’ নামক বইয়ের ২৩৮-২৩৯ নং পৃষ্ঠায় কালয়ূবী কিতাবের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে।  জানা কথা, কালয়ূবী না হাদীসের কিতাব আর না সীরাত ও তারীখের কিতাব। এটি আরবী সাহিত্যের সাধারণ একটি পাঠ্যভুক্ত কিতাব। এতে উল্লেখিত ঘটনাসমূহে শুদ্ধাশুদ্ধির বিষয়টি লক্ষণীয় ছিল না বিলকুল।

যাইহোক, একে তো ঘটনাটি ভিত্তিহীন; কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে তা পাওয়া যায় না; তথাপি উক্ত মকছুদোল মো’মেনীনে ঘটনাটিকে উদ্ধৃত কালয়ূবী কিতাবে বর্ণিত কিসসা থেকেও বাড়িয়ে আরো রং চং মাখিয়ে পেশ করা হয়েছে, যার দ্বারা এ বানোয়াট ঘটনাটির কদর্যতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, লেখা হয়েছে-
‘একদিন হযরত ঈসা আ. জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, হে খোদা তাআলা! এ যামানায় আমার চেয়ে বুযুর্গ আর কেহ আছে কি?...’
উদ্ধৃত কিতাবে এ অংশ নেই। একজন নবীর সাথে এরকম কথা যুক্ত করা কত বড় বেয়াদবী।
আরো লেখা হয়েছে-
‘গায়েব হইতে আওয়ায হইল, হে ঈছা! তুমি তোমার হাতের আশা’ দ্বারা ঐ প্রস্তরের উপর আঘাত কর। তিনি তাহাই করিলেন। আঘাত পাওয়া মাত্র পাথরখানি ফাটিয়া দুই ভাগ হইয়া গেল।’
এ অংশও নিজ থেকে যুক্ত করা। আছা তথা লাঠির সম্পর্ক মূসা আলাইহিস সালামের সাথে সাজে; যুক্তকারী এটাও খেয়াল করলেন না। ঘটনার চমক বাড়ানোর জন্য ঈসা আ.-এর সাথেই ‘আছা’ যুক্ত করে দিলেন!
তারপর উদ্ধৃত কিতাবে শুধু রাতের নামাযের কথা ছিল; লেখক নিজ থেকে নিজের মত করে দিনের রোযার কথাও যুক্ত করে দিয়েছেন।
সবশেষে আরো মুনকার কথা যুক্ত করলেন-
(ফযীলত শুনে) ‘ঈছা আ. কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিলেন, হে খোদা তাআলা! তুমি আমাকে নবী না করিয়া আখেরী যামানার নবীর উম্মত করিতে...।’
‘হে খোদা তাআলা! তুমি আমাকে নবী না করিয়া’- একজন নবী কি একথা বলতে পারেন? তাছাড়া শ্রোতাদের উপর ঘটনাটির সুপ্ত প্রতিক্রিয়া এই পড়তে পারে যে, শবেবরাতের আমলের মাধ্যমে কারো মর্যাদা -নাউযুবিল্লাহ- নবীর চেয়েও বেড়ে যেতে পারে!
মোটকথা, কিসসাটি ভিত্তিহীন। সাথে সাথে জেনে রাখা দরকার, মকছুদোল মো’মেনীন জাতীয় কিতাবে এরকম ভিত্তিহীন বিষয় থাকার পাশাপাশি জাল বর্ণনার সাথে বুখারী, তিরমিযী ইত্যাদি মিথ্যা উদ্ধৃতিও লিখে দেওয়া হয়; শবে বরাত বিষয়ক ভিত্তিহীন বর্ণনার আলোচনা করতে গিয়ে সেপ্টেম্বর ২০০৬ সনে প্রচলিত ভুল বিভাগেই এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। আল্লাহ আমাদের সব বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সঠিকটা জেনে আমল করার  তাওফীক দিন এবং বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি থেকে রক্ষা করুন। সাথে সাথে ইলমী আমানত রক্ষা করার তাওফীক দিন।

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

একটু চিন্তা করুন ।

                      أعوذ بالله من الشيطان الرجيم                           بسم الله الرحمن الرحيم                 সকল মুসলিম ভাই বোন ক...

Search This Blog

Followers